দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে না, মানুষের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তাদের করার কিছু নেই। এমন প্রশাসনিক ব্যর্থতা বহু বছর দেখে না বাংলাদেশের মানুষ।

রতন হোসেনের গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের পাবনার ইশ্বরদীতে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য ঢাকার মিরপুরের পল্লবীতে উঠেছেন। মেয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে।

গত জুলাই আগস্টে সরকার পতন আন্দোলনে রতন সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তার সন্তানেরা প্রতিবাদে যাচ্ছে দেখে তিনিও বসে থাকতে পারেননি।

বাংলা নিউয নেটওয়ার্ককে রতন বলেন, ‘সরকার পতনের পর ছেলেমেয়েদেরকে বলেছি, অনেক বড় ভুল করে ফেললি। এখন তো এ কথা আরও বেশি মনে হয়।’

করোনাভাইরাস মহামারী শেষে বিশ্বে খাদ্যমূল্য, জ্বালানি ও শিল্পের কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়তে থাকে দেশে দেশেই। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও।

এর মধ্যে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। উন্নয়নশীল দেশ তো বটেই, সংকটে পড়ে উন্নত দেশগুলোও। এই সংকটের প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও, কমে আসতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, জ্বালানি সংকটে ফিরে আসে বিদ্যুতের লোডশেডিং, পড়ে যায় মুদ্রার মান, দেখা দিতে থাকে মূল্যস্ফীতি।

এ সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হতে থাকে লুটপাট আর অর্থপাচারের কারণে রিজার্ভ কমছে, বিদ্যুৎ খাতের অভাবনীয় উন্নতিকেও অস্বীকার করা হয়। নানা মহল থেকে আসা এসব বক্তব্যের প্রভাব জনগণের মধ্যে যে পড়েছিল, সেটি অস্বীকার করার জো নেই।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেখা গেল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের ইচ্ছা, আন্তরিকতা তো বটেই যোগ্যতারও অভাব। প্রবীণ সাংবাদিক নুরুল কবীরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস নিজে স্বীকার করেছেন দেশ চালানোর মত যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা তার ও তার উপদেষ্টা পরিষদের নেই।

তার চেয়ে ভয়ানক যে কথা তিনি বলেছেন, সেটা হলো উপদেষ্টা পরিষদ বেছে নেওয়ার সময় যাকে পাওয়া গেছে তাকেই নিতে হয়েছে।

পাঁচ মাস পর রতন হোসেন কেন হতাশ, তা দেশের চিত্রেই বোঝা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শুনতাম, এর সত্য মিথ্যা নিয়ে এখন তো প্রশ্ন জাগছে। আবার শেখ হাসিনা তো ভালো কাজও করেছেন অনেক। কিন্তু এরা (বর্তমান সরকার) তো কেবল কথা বলে, কিছুই করে না। এটা কী হলো? দেশটা পিছিয়ে পড়ল।’

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথাতেও রতনের এই বক্তব্য ফুটে ওঠে। তিনি এখনও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করে যাচ্ছেন, তবে তিনি ভয় পাচ্ছেন, দেশের যে পরিস্থিতি, তাতে মানুষ তাদের তোলা সেসব কথা ভুলে যায় কি না।

গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ খাত নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল বলেন, ‘রাজনৈতিক তর্ক বিতর্কে আওয়ামী লীগের যে দুর্বৃত্তায়ন, তাদের যে চুরি, লুটপাট, এটা কিন্তু নিচে পড়ে যাচ্ছে, এরা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে।’

এই রতন হোসেন কেবল ব্যক্তি বিশেষ না। হাজারো, লাখো মানুষ যারা আন্দোলনে গিয়েছিল, এখন প্রশ্ন তুলছে, দেশের এই অধঃপতিত অবস্থা কেন? আইনশৃঙ্খলার চরম দুরাবস্থার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলে যাচ্ছেন তার হাতে ম্যাজিক নেই, প্রধান উপদেষ্টা বলছেন, তাদের দেশ চালানোর যোগ্যতা নেই, তিনি বাজি ধরেছেন, লাগলে লাগল।

এমন প্রশাসনিক ব্যর্থতা বর্তমান প্রজন্মের মানুষ কবে দেখেছিল?

অর্থনীতির ১২টা বেজে গেছে 

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ছে, টাকার মান পড়ছেই, দেশে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে, বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, অর্থনীতির চাকা স্থবির।

ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস দ্রুতই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ডিসেম্বর শেষে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১১ শতাংশ, এর মধ্যে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৩ শতাংশ।

নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা খাদ্যে ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, খাদ্যে ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির যে গতির কারণে বাংলাদেশকে উন্নয়নের উদাহরণ হিসেবে দেখানো হত, সেই বাংলাদেশে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির হার নেমেছে ১ দশমিক ৮১ শতাংশে।

আগের বছর একই সময়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে সরকার বাজেট প্রস্তাব করেছিল।

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ যা বিনিয়োগের একটি নির্ণায়ক, তাও ক্রমাগত কমছে। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী নভেম্বরে এই হার নেমেছে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশে, যা গত ৪২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারীর সময় লকডাউন পরিস্থিতিতেই কেবল এতটা নিচে নেমেছিল ঋণপ্রবাহ।

বিনিয়োগ খরায় যা হওয়ার তাই হয়েছে, বেড়ে গেছে বেকারত্ব। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম মানুষদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎে বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। আগের বছর একই সময়ে বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ০৭ শতাংশ, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশে।

সরকারের যে উন্নয়ন প্রকল্প, তাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। জুলাই থেকে নভেম্বর- এই পাঁচ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে কেবল ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে সরকার যেখানে ৪৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা খরচ করতে পারে, সেখানে চলতি বছর খরচ হয়েছে ৩৪ হাজার ২১৪ কোটি টাকা।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমায় টান পড়েছে রাজস্বের। ওদিকে রাজস্ব বাড়াতে আইএমএফের চাপে ৪৩টি পণ্য ও সেবায় ভ্যাটের হার করা হয়েছে ১৫ শতাংশ। রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে হলে, জামা কাপড় কিনতে হলে এখন ৫ শতাংশের জায়গায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও বাড়ানো হয়েছে ভ্যাটের হার।

প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও আইএমএফ এই চাপ দিয়েছে, সে সময় সরকার অগ্রাহ্য করতে পারলে এখন কেন পারছে না, কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো জবাব সরকারের তরফে দেওয়া হচ্ছে না।

উগ্রবাদের বিকাশ

ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাংলাদেশ যে আরেকটি বড় বিপদের মধ্যে পড়ে গেছে, তা হলো ইসলামি চরমপন্থার বিকাশ

গত ৫ মাসে ঢাকা শহরে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটস আর আফগানিস্তানে তালেবানের পতাকা যত বিক্রি হয়েছে, তত বিক্রি হয়নি বাংলাদেশের পতাকা। জঙ্গি সংগঠনের পতাকা নিয়ে ছেলেরা প্রকাশ্যে মিছিল করেছে, খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলছে, কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে এমন নজির নেই।

নিষিদ্ধ উগ্রবাদী সংগঠন হিযবুত তাহরীর নির্বিঘ্নে পোস্টার সাঁটাচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে চলছে ব্যাপক প্রচার, প্রকাশ্যেই চলছে জমায়েত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তার করেছে, এমন উদাহরণ পাওয়া কঠিন। তারা ব্যস্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

সরকারের হাত গুটিয়ে রাখার ঘটনায় যে বার্তা মাঠ পর্যায়ে যাচ্ছে, তা হলো ধর্মের নাম করে এখন যা খুশি করা যাবে, কেউ কিছু বলবে না। বরং প্রশাসনিক সহায়তাও আসতে পারে।

গত ৫ জানুয়ারি রাতে নীলফামারী সদর উপজেলার বাবরীঝাড় স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে কনসার্টের মঞ্চ ভাঙচুর করছে কিছু যুবক।

আয়োজক কমিটির সদস্য বাসু ইসলামের ভাষ্য, প্রশাসন ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল।

হামলার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। তবে হামলাকারীদেরকে কিছু না বলে উল্টো কনসার্টই বন্ধ করে দেয়।

অথচ ঢাকায় পাকিস্তানি শিল্পী রাহাত ফতেহ আলী খানের কনসার্ট নিয়ে কত মাতামাতি হয়ে গেল। সেখানে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, এমনকি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের টোলও মওকুফ করা হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here