নিউইয়র্ক স্টেটের রাজধানী আলবেনীর ‘লেথাম রিজ স্কুল’ চত্বরে ‘বাংলাদেশী আমেরিকান ফাউন্ডেশন অব আলবেনী’ (বাফা) এর আয়োজনে বিজয় দিবস উদযাপিত হয়েছে। আবহাওয়ার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শনিবার (২১ ডিসেম্বর) দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাঙালিদের উপস্থিতি ছিল উৎসবমুখর।

আবহাওয়ার প্রচণ্ড প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে সকাল থেকেই সংগঠনের নারী-পুরুষ এবং শিশুদের লাল-সবুজ পোষাকে বাফাকর্মী ও কমিউনিটির বাঙালিদের আগমন, নিবন্ধন, কুশল বিনিময়, আলোকচিত্র ধারণ, বিভিন্ন স্টলে কেনাবেচা এবং সাজসজ্জার ব্যস্ততায় যেন একটুকরো লাল-সবুজের বাংলাদেশ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছিল স্কুল প্রাঙ্গনে ।

সকাল গড়িয়ে দুপুর ভর করতেই চত্বরটি আলবেনীর বাঙালিদের একটি বিশাল মিলনমেলায় পরিণত হয় । বিশেষত শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বসিত হৈচৈ আর আনন্দে মাতোয়ারা ছিল চারদিক।
ভীষণরকম উৎসবমুখর পরিবেশে সুস্বাদু নানা ধরণের খাবারের পরিবেশন ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বাফা স্বেচ্ছাসেবক দলের সুশৃঙ্খলভাবে বিজয় দিবসের খাবার পরিবেশনের ব্যাবস্থাপনা ছিল চোখে পড়ার মতো। মিষ্টান্ন থেকে শুরু করে কোমল পানীয়, চা, কফি কোনো কিছুরই কমতি ছিল না। খাবার পর্ব শেষ করে পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী সবাই অডিটরিয়ামে নিজ নিজ আসন গ্রহণের পর বিকেল ৩.০০ টায় শুরু হলো বিজয় দিবস উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা।
অনুষ্ঠানটি চারটি পর্বে বিভক্ত ছিল। ১ম পর্বে শুধুমাত্র শিশু- কিশোরদের পরিবেশনা ‘হৃদয়ের গভীরে ভালোবাসায় আঁকা প্রিয় বাংলাদেশ প্রিয় আমেরিকা’ পর্বটিতে প্রথমে বাংলাদেশ এবং অ্যামেরিকা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়, পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রহিম বাদশাহ।

পরবর্তীতে দেশাত্ববোধক গানের সাথে নৃত্য পরিবেশিত হয়, কোরিওগ্রাফার ছিলেন তানিয়া মানির। প্রথম পর্বে অংশ গ্রহণকারী শিশুরা হচ্ছেন আফিজা চৌধুরী, আলিশা হক, আরিবা তারিক, আরমীণ ভুঁইয়ান, ফাইজা ফরহাদ, ফারিয়া হক, মাহাদ তারিক, মাহ্ রাস কাজী, মুয়াদ আহমেদ, নাজিয়া হুদা, নিহাল মাসুদ, রাযিন রাইসা, রিহান বাদশাহ, সাফা জামান, সিফান আহমেদ, সঞ্জিতা শিকদার, শাহান রাকিন আনোয়ার, সুমায়রা রাহা আহমেদ, তাসকিন আরেফিন, তাজমীন জামান, জাহিন হোসেন, জাহিয়া জামান, এবং জারিয়া আহমেদ।

২য় পর্বে ছিল বিজয় দিবসের আলোচনা এবং স্পন্সর পরিচিতি পর্ব। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বাফার চেয়ারম্যান ড. হুমায়ুন কবির এবং প্রেসিডেন্ট সোহেল আহমেদ। বক্তাগণ স্বাধীনতা আন্দোলনের সকল মহান নেতৃত্ব, সংগঠক, ৩০ লক্ষ শহীদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা সকল স্তরের বাঙালিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং তাঁদের ত্যাগের কথা স্মরণ করে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁরা বাংলা সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে বাফা পরিবারের আগ্রহকে সাধুবাদ জানান।

বিশেষত নতুন প্রজন্মের অ্যামেরিকান- বাঙালি শিশুদের মনে শেকড়ের প্রতি সম্মান এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে বাঙালি সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য পিতামাতার অব্যাহত প্রচেষ্টাকে অভিনন্দিত করেন। অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনদের ভেতর আরও যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা হলেন ক্লিফটন পার্কের টাউন সুপারভাইজার এবং চেয়ার অব দা স্যারাটোগা কাউন্টি বোর্ড সুপারভাইজার মি: ফিল ব্যারেট ও ক্লিফটন পার্ক টাউন জাজ অনারেবল রবার্ট রাইবেক। তাঁরা উভয়েই অনুষ্ঠানের সবগুলো পর্ব উপভোগ করেন এবং অনুষ্ঠান শেষে শিল্পীদের অভিনন্দিত করেন।
আয়োজনের অন্যতম স্পন্সর নিউইয়র্ক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন নিউইয়র্ক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ফাইন্যান্সিয়াল প্ল্যানার এবং এজেন্ট সাংবাদিক সুলতানা রহমান পুতুল এবং অফিস পার্টনার মিঃ ব্র্যানডন কার্ল ।এসময় তাঁরা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কীভাবে ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটির অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে পারে এবং পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সেবিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যাঁরা সহযোগিতা করেছেন তাঁরা হলেন মোঃ আহসানুল হক (রিয়্যালটি ওয়ান গ্রুপ) এবং আলাদীন হালাল গ্রুপ।
৩য় পর্বে বাফা সদস্যদের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয় গীতিনৃত্যালেখ্য ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না’ । ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে পলাশির প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে ১৯৭১ খৃষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন পর্যন্ত এক সুদীর্ঘ সময়ের অব্যাহত আন্দোলন, সংগ্রাম, আত্মউৎসর্গ আর ত্যাগের মহিমান্বিত উপাখ্যানের আলোকে গীতিনৃত্যালেখ্যটির স্ক্রীপ্ট, গ্রন্থনা, পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিলেন আবৃত্তি শিল্পী আনোয়ারুল হক লাভলু।

বাফা আলবেনীর, সঙ্গীত, নৃত্য এবং আবৃত্তির একত্রিশ জন শিল্পীর অংশগ্রহণে পরিবেশিত গীতিনৃত্যালেখ্যটিতে যে সব কবি এবং লেখকদের গান, কবিতা এবং লেখা সংযোজিত হয়েছে তাঁরা হচ্ছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মুকুন্দ দাস, মোহিনী চৌধূরী, আব্দুল গাফ্ফার চৌধূরী, আব্দুল লতিফ, গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, গিরীন চক্রবর্তী, শামসুর রাহমান, সিকান্দার আবু জাফর, সৈয়দ শামসুল হক, প্রতুল মুখোপধ্যায়, ফজল শাহাবুদ্দীন, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, নঈম গওহর, নজরুল ইসলাম বাবু, আনোয়ার হোসেন রনি, আনোয়ারুল হক লাভলু এবং কবি বেনজির শিকদার।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আনিকা সুবাহ আহমদ উপমা, কবি বেনজির শিকদারের ‘বিজয় উৎসব’ কবিতা আবৃত্তির মধ্যদিয়ে পর্বটির সূচনা করেন এবং আবৃত্তিশিল্পী আনোয়ারুল হক লাভলুর ইতিহাস কথনের মধ্যদিয়ে দর্শকবৃন্দ গীতিনৃত্যালেখ্য ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না’ এর মুল পর্বে প্রবেশ করেন।

পিন পতন নিরবতায় ইতিহাস, কথা, কবিতা, নৃত্য এবং সঙ্গীতের মূর্ছনায় সেই বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বীরগাথার বর্ণনায় হল ভর্তি দর্শকের অনেকেই ফিরে যান ৭ই মার্চে, ফিরে যান একাত্তরে, ফিরে যান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে। কেউবা শেকড়ের গৌরবগাথায় বারবার শিহরিত হতে থাকেন। এমনকি এসময় অনেক দর্শক অশ্রুসজল হয়ে পড়েন। ‘বিজয় উৎসব’ কবিতার শেষ লাইনটি “শোক নয় শোক নয় হোক উৎসব” সকল শিল্পীদের কণ্ঠে সমবেত উচ্চারণের মধ্যদিয়ে গীতিনৃত্যালেখ্য ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না’র পরিবেশনা শেষ করা হয় ।