গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে। কেবল চার দিন আগে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল তার মেয়ে মাসুমা। বাবাকে হারিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে যাওয়া শিশুটির জন্য সরকারের কেউ কাঁদেনি। কারণ সম্ভবত, তার বাবাকে খুন করেছে শিবির কর্মীরা।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে একটি ছবি মানুষের হৃদয় কেড়ে নেয়। এক নারীর কোলে ছিল কেবল ৫ দিন বয়সী কন্যা শিশু মাসুমা আক্তার।
বাবার লাশ নিতে মায়ের সঙ্গে এসেছিল শিশু মাসুমা, যার এই পৃথিবীর নৃশংসতা বোঝার সময় হবে না আরও বহু বছরেও।
বাবাকে চেনার আগেই, তার আদর ভালোবাসা পাওয়ার আগেই মেয়েটিকে এতিম করেছে রাজশাহীর ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী সমর্থকরা। তার বাবাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এরপর প্রায় তিন মাস কেটে গেল, মাসুমা কেমন আছে, তার মায়ের দিন কীভাবে কাটছে, পেটে ভাত জুটছে কি না, সেই খবর কেউ নেয়নি।
তবে চট্টগ্রামে সংঘর্ষে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের পরিবারের অন্তত এই দুর্গতি হবে না।
তার তিন বছর বয়সী কন্যা সন্তান তাসকিয়া ইসলাম আর মায়ের পেটে চার মাসের গর্ভে থাকা অনাগত সন্তানও এতিম হয়েছে। তবে সরকারের উদ্যোগ আর বিভিন্ন সংগঠন এগিয়ে আসায় পরিবারটিকে অর্থকষ্টে ভুগতে হবে না।
পার্থক্য হলো, মাসুমার বাবা আবদুল্লাহ আল মাসুদ এক কালে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। ২০১৪ সালে ছাত্র শিবির হামলা চালিয়ে তার একটি পা কেটে নেয়। এরপর রাজনীতি থেকে সরে গিয়েও তিনি বাঁচতে পারেননি। এক দশক আগে হত্যার উদ্দেশে চালানো হামলার মিশনটি সরকার পতনের পর সুযোগ বুঝে সফল করে শিবির কর্মীরা।
অন্যদিকে আলিফ হত্যার পর তাকে জামায়াত নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছে যদিও আইনজীবীদের সমিতিতে তিনি বিএনপির অংশের সঙ্গে উঠাবসা করতেন।
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে জামিন না দেওয়ার চট্টগ্রামে প্রতিবাদকারীদের ওপর আক্রমণের সময় আইনজীবী হয়েও অংশ নেন আলিফ। তারা স্থানীয় মেথর পট্টিতে হামলার পর পাল্টা হামলায় নিহত হন আলিফ।
সরকার পতনের আন্দোলন ৫ আগস্ট সফল হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী সমর্থকদের বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানায় দেদার হামলা, লুটপাট, খুনের মচ্ছবের মধ্যে সরকারের পক্ষের একজনের প্রাণহানি ব্যাপক বড় হয়ে গেছে।
সরকার পতনের আগে থেকেই ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত করা কোনো খুনের বিচার হবে না বলে আদেশ জারি হয়েছে। আর ৮ আগস্টের পরে যেসব হত্যা হচ্ছে, সেগুলোর বিচার যে আদৌ হবে না তার প্রমাণ তো এরই মধ্যে হয়ে গেছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করে দিতে চালানো গ্রেনেড হামলায় সাজাপ্রাপ্ত সবাইকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছে ইউনূস সরকারে আসার পর উচ্চ আদালতে নিয়োগ করা বিচারকরা।
এখন যারা হত্যার শিকার হচ্ছে, তাদের পরিবারও যে বিচার পাবে না, নেই বিষয়টিরও ইঙ্গিত স্পষ্টই। প্রথমত শত শত পরিবারের মামলা করার পথই রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে আইনে। দ্বিতীয়ত, মামলা করলেও পুলি আসামি ধরছে না, আসামি ধরলেও জিজ্ঞাসাবাদই করছে না। হত্যার ভিডিও আছে, কিন্তু তদন্ত থমকে আছে।
গত ২৬ অক্টোবর রাজশাহীতে প্রকাশ্যে ধরে চ্যাংদোলা করে নিয়ে ক্যামেরার সামনেই পায়ে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয় এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান মো. মীমকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে এক যুবলীগ নেতার ফুট ফরমাশ খাটতেন তিনি।
সেই ঘটনার ভিডিও এখনও ফেসবুকে ঘুরে বেড়ায়। মীমের মা ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ৮ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে পরের দিন বোয়ালিয়া থানায় মামলা করেন। পুলিশ সেদিনই চারজনকে গ্রেপ্তারও করে, কিন্তু এক মাস পেরিয়ে গেছে, তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি। আদালতে রিমান্ড আবেদনের শুনানির আবেদন কবে, সেই সিদ্ধান্তই জানাচ্ছে না আদালত।
তারও আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাকে পেটানোর ভিডিও ছড়িয়েছে, তাতে দেখা যায় সরকার পতন আন্দোলনের সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আহসান লাবিবের নেতৃত্বে হয় এই হত্যা।
আড়াই মাস পরে এসে জানা যাচ্ছে এই তদন্ত থমকে আছে। লাবিবকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, তার সঙ্গে থাকা আরেক সমন্বয়ক তৌহিদ সিয়ামকে আসামিও করা হয়নি। মামলার পর লাবিব প্রকাশ্যে আসছেন না, কিন্তু সিয়াম কেবল প্রকাশ্যেই না, তিনি গণঅভ্যুত্থান রক্ষা কমিটির নেতা হিসেবে ব্যাপক তৎপর।
একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীনকে খাবার খাইয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়। তীব্র সমালোচনার মুখে উপদেষ্টারা বলেন কঠোর ব্যবস্থা হবে। মামলাও হয়। কিন্তু সব আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। তদন্ত থমকে।
এর কারণ হলো, খুনিরা সবাই সরকার পতন আন্দোলনে জড়িত ছিল। তাদের করা এক খুনের বৈধতা দিয়ে আরেকটির বিচার করা মনে হয় দৃষ্টিকটুই হয়।
মাসুমা বড় হয়ে হয়ত জানবে তার বাবা আবদুল্লাহ আল মাসুদের খুনিদের বিচার হয়নি। হয়ত অর্থকষ্টে ধুঁকে ধুঁকে চলবে তা মাসুদের পাঁচদিন বয়সী কন্যা জীবন। হয়ত ফুটবে না তার জীবনের ফুল।
অথচ সাইফুল ইসলাম আলিফের তিন বছর বয়সী মেয়ের নাম তাসকিয়া ইসলাম আর তার মায়ের গর্ভে চার মাস ধরে থাকা শিশুর জন্মের পরে আর যাই হোক অর্থকষ্ট হবে না।
গত ২৬ নভেম্বর সংঘাতে নিহত হন আইনজীবী আলিফ। পরের তিন তার জানাজায় অংশ নিতে ছুটে যান উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। ঢাকা থেকে ছুটে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম। তিন দিন পর ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিধান চন্দ্র রায় পোদ্দার।
ধর্ম উপদেষ্টা আলিফের পরিবারের হাতে সাত লাখ টাকার চেক তুলে দেন। এর মধ্যে ৬ লাখ টাকা দিয়েছে দুটি বেসরকারি সংগঠন। আর এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে আলিফের পরিবারের জন্য গঠন করা একটি তহবিল থেকে।
ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, ‘কীভাবে এই পরিবারটা স্বচ্ছলভাবে চলতে পারে, তারা যাতে আর্থিক অসঙ্গতিতে না পরে এ ব্যাপারে আমরা সচেতন।‘
আলিফের পরিবারের জন্য কোটি টাকার তহবিল করার ঘোষণাও দেন ধর্ম উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এগুলো আমরা উনার বাবা ও স্ত্রীর সাথে কথা বলে একটা অ্যাকাউন্টে রেখে তারা যাতে বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে চলতে পারে এর ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি।’

রাজশাহীর শিশু মাসুমার বাবা আবদুল্লাহ আল মাসুদ। তাকে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করে শিবির কর্মীরা।
অথচ মাসুদের সন্তান মাসুমার পাশে দাঁড়াতে সরকারের কেউ ছুটে যাননি। তার ভবিষ্যতের জন্য দুটো টাকা সঞ্চয়ের ব্যবস্থা হয়নি।
গত ১০ সেপ্টেম্বর মাসুদের পরিবারের জন্য অর্থ সহায়তা চেয়ে আহ্বান জানায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলটির কর্মী সমর্থকরা এখন এই অবস্থায় নেই যারা তার মেয়েটিকে কাছে গিয়ে একটু কোলে নেবে, স্নেহের হাত বুলিয়ে দেবে।
মাসুদের স্ত্রীর নামে একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। মোসা: বিউটি য়ারা বেগমের নামে সঞ্চয়ী হিসাব নং- ০২০০০২২৬৬৩৫০১, অগ্রণী ব্যাংক, বিনোদপুর শাখা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; রাউটিং নম্বর: ০১০৭০০১৯০। এই হিসাবে চাইলে যে কেউ সহায়তা পৌঁছে মাসুমার জীবনটাকে কঠিন হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবে।
০১৭৮৪৫৫৮৩৭০ নম্বর দিয়ে বিকাশ ও নগদের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবও চালু হয়েছে। মাসুদের মৃত্যুর পর বিউটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আবাসন ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে উঠেছেন বাবার বাড়ি। এখন পর্যন্ত কোন আর্থিক সহায়তা তো দূরের কথা, একবার খোঁজও নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
মাসুদকে হত্যার বিচার হবে তো?
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে মাসুদ যখন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত, তখন ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল ক্লাসে যাওয়ার পথে ক্যাম্পাসে তার ওপর হামলা করে শিবির কর্মীর।
তার ডান পায়ের নিচের অংশ গোড়ালি থেকে কুপিয়ে আলাদা করে ফেলে শিবির কর্মীর। বাঁ পাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেটে দেওয়া হয়েছিল তাঁর হাতের রগ। পা হারানোর পর তিনি একটি প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাচল করতেন।
নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে একটি চাকরি চেয়ে ২০২২ সালের শেষ দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লেখেন মাসুদ।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক পরিচালক উপাচার্যের কাছে পাঠানো চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে তাকে নিয়োগ দিতে বলেন। ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর মাসুদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে নিয়োগ দেয় কর্তৃপক্ষ।
গত ৭ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে কন্যা মাসুমার জন্য বিনোদপুর বাজারে ওষুধ কিনতে গেলে তাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করে শিবির কর্মীরা।
মৃত্যুর আগে মাসুদ এলাকাবাসীর কাছে তার কন্যা সন্তানের দোহাই দিয়ে পানি খেতে চেয়েছিলেন। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু সরকারের কাছে তা পৌঁছতে পারেনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস জমানায় আইনের শাসনের এমনই অবস্থা যে, এই ঘটনায় কারও নাম উল্লেখ করে মামলা করতে পারেননি মাসুদের ভাই মো. বেহেস্তী।
থানা পুলিশ মামলার পর কিছু করেনি। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য পাঠানো হয় ডিবির কাছে। মতিহার থানার ওসি আবদুল মালেক বলেন, ‘মামলা আমাদের কাছে থাকা অবস্থায় কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।’
রাজশাহী মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক ফারুক হোসেন বলেন, ‘মামলাটি কার কাছে আছে তা জানি না।’
মাসুদের বড় ভাই মো. বেহেস্তী বলেন, ‘কোনো আসামি এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে বলে শুনিনি। গ্রেপ্তার হলে তো শুনতাম।’
পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বলে লাভ কী ‘এটা তো আমাদের কাজ না। যাদের কাজ তারা কাজটা করলেই তো হয়।’