চট্টগ্রামে সংঘর্ষে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের মৃত্যুর পর ব্যাপক তৎপর পুলিশ ও সরকার। কিন্তু আড়াই মাস আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও থাকার পরেও আসামিদের ধরতে পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে বেছে বেছে ব্যবস্থা নেওয়ার যে ঘটনা ঘটছে, তার সউদাহরণ চট্টগ্রামে সংখ্যালঘুদের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানোর পর সংঘর্ষে আইনজীবী হত্যার ঘটনাটি।
সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে সেই আইনজীবীকে হত্যার পর মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার, পুলিশ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিএনপি, জামায়াতের ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় আড়াই মাস আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কের নেতৃত্বে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা হত্যার ঘটনায় দায়ীদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করতে পুলিশের ন্যূনতম উদ্যোগ নেই। ঘটনার ভিডিও ফুটেজে কারা পিটিয়েছিলেন, তার সবই স্পষ্ট। কিন্তু তদন্ত থমকে আছে।
হত্যার পর পর তুমুল সমালোচনার মুখে দুই জনকে গ্রেপ্তার করলেও প্রধান আসামি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক আহসান লাবিবকে গ্রেপ্তারে কোনো উদ্যোগ নেই। ঘটনার আড়াইু মাসেও তদন্তে অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
চট্টগ্রামে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার আগের যেসব ফুটেজ প্রকাশ হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, সেদিন একদল মানুষ চট্টগ্রামে আদালতের কাছে মেথর পট্টিতে হামলা করে। সেই হামলাকারীদের ডেকে ডেকে এগিয়ে যেতে আলিফের অঙ্গভঙ্গি স্পষ্ট। পরের ফুটেজে দেখা যাচ্ছে আলিফ আহত হওয়ার পর তাকে অটোরিকশায় করে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পরে হাসপাতালের ফুটেজে দেখা যায় তার পিঠে ধারালো অস্ত্রের ক্ষত।
কিন্তু সেদিন গুজব ছড়ায় আলিফকে জবাই করে হত্যা করেছে হিন্দুদের সংগঠন ইসকনের সদস্যরা। এই ঘটনায় ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মাঠে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এর মধ্যে পুলিশ ফুটেজ দেখে আট জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। এদের মধ্যে সেদিন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় করা মামলার আসামি হিসেবে আছেন রুমিত দাশ, গগন দাশ, সুমিত দাশ, নয়ন দাশ, বিশাল দাশ, মনু মেথর, আমান দাশ ও রাজীব ভট্টাচার্য। তারা হত্যায় জড়িত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এরা সবাই সেই মেথর পট্টির বাসিন্দা। অর্থাৎ সেখানে আক্রমণ হওয়ার পর পাল্টাপাল্টি আঘাতে মৃত্যু হয় আলিফের।
হত্যায় জড়িত থাকলে তার শাস্তি হবে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ছাড়া কেউ দ্বিমত করবে না। তারা দ্বিমত করতে পারে এ কারণে যে, কিছু হত্যার বিচার হবে না, এমন আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করেছে। আবার শামীম মোল্লার মতো আরও অনেক হত্যার বিচারে কোনো উদ্যোগ নেই, যদিও সেগুলোর ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে, শত শত প্রত্যক্ষদর্শী আছে।
আইনজীবী আলিফের পরিবারের জন্য কোটি টাকা তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন ধর্ম উপদেষ্টা ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। তার জানাজায় ছুটে গেছেন ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। কিন্তু শামীম মোল্লাসহ আরও অনেক হত্যা নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই। কেউ কোনো প্রতিক্রিয়াই দিচ্ছে না। গত ২৫ নভেম্বর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সনাতনী জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগরের গোয়েন্দা পুলিশ। পরের দিন তাকে চট্টগ্রামের আদালতে তোলা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ সভা সমাবেশ করছিলেন তিনি। চট্টগ্রামে একটি সমাবেশে বাংলাদেশের পতাকারও পর গেরোয়া পতাকা তোলার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়। শামীমকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা, ভিডিওতে যা সবই স্পষ্ট।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে একদল শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন। আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এই হত্যার পর সব চুপচাপ। আরও কোনো পদক্ষেপ নেই।
মুশকিলটা বাধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীনকে খাবার খাইয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হলে।
দুটি ঘটনায় তুমুল সমালোচনার মুখে হত্যার ২৪ ঘণ্টা পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আশুলিয়া থানায় মামলা করা হয়। ওই মামলায় আসামি হিসেবে আট শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করা হয়।
মামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক আহসান লাবিব ছাড়াও রাজু আহাম্মদ, মাহমুদুল হাসান রায়হান, জুবায়ের আহমেদ, হামিদুল্লাহ সালমান, মো. আতিকুজ্জামান, সোহাগ মিয়া, ও মোহাম্মদ রাজন মিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়।
তীব্র সমালোচনার মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমন্বয়ক আহসান লাবিবকে সাময়িক বরখাস্ত করে। জানানো হয়, এই বরখাস্তের আদেশ ততদিন থাকবে, যতদিন এই আদেশ বহাল থাকবে।
কিন্তু তদন্তের যে গতি, তাতে এর সুরাহা কবে হবে বা আদৌ হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল ও শামীম হত্যার ঘটনাটি কাছাকাছি সময়ে হওয়ার পর উপদেষ্টারা এ নিয়ে কথা বলতে বাধ্য হন এবং মামলা হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাহমুদুল ইসলাম রায়হান ও সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এরপর হাবিবুন নবী নামে একজনকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে তার পরিচয় আসে, তার আসল নাম হাবিবুর রহমান খান, তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতেই জড়িত।
ছাত্রলীগের কর্মীকে পিটিয়ে হত্যায় এই সংগঠনের কর্মীকেই গ্রেপ্তার দেখানো নিয়ে সমালোচনার মধ্যে পুলিশ কৌশল পাল্টায়। এক দিন পরে তাকে পোশাক খাতে অস্থিতিশীল করার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে চালান দেওয়া হয়।
মামলাটি এক পর্যায়ে থানা পুলিশ হয়ে যায় তদন্তের বিশেষায়িত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআইয়ের হাতে। যে হত্যার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ আছে, তাতে কারা কারা শামীম মোল্লাকে পিটিয়েছে, সেই বিষয়টি স্পষ্ট, এমনকি সেদিন কী কী কথাবার্তা হয়েছে, সেটিও শোনা যাচ্ছে। সেই ঘটনার তদন্তও কেন ঝুলে গেছে, কেন আসামিদের গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না, সে প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।
মামলাটি তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এখন এসআই আনিসুর রহমানের হাতে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা পিবিআই এটা পাওয়ার পর কিছু কার্যক্রম চলছে। পুরোপুরি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যে ফলোআপ, সেটি অনুযায়ীই এটি এটি পরিচালিত হচ্ছে। বলার মত কোনো অগ্রগতি নেই।’
দুই জন ছাড়া অন্য কোনো আসামি কি গ্রেপ্তার আছেন?- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নতুন কোনো অ্যারেস্ট নাই ভাই।’
এক সমন্বয়ক আসামি, ঘুরে বেড়াচ্ছেন আরেকজন
শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার যে ভিডিওগুলো প্রকাশ হয়েছে, তাতে তাকে পেটানোর সময় যারা যারা ঘটনাস্থলে ছিলেন, তাদের সবাইকে আসামিও করা হয়নি।
যেমন লাবিব যখন প্রক্টর অফিসের সামনে তাকে পেটাচ্ছিলেন, তখন পাশে ছিলেন আরেক সমন্বয়ক তৌহিদ সিয়ামকে। মামলার পর লাবিব প্রকাশ্যে আসছেন না, কিন্তু সিয়াম কেবল প্রকাশ্যেই না, তিনি গণঅভ্যুত্থান রক্ষা কমিটির নেতা হিসেবে ব্যাপক তৎপর।