ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। যদিও তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এখনও প্রায় এক মাস বাকি, বিশ্ব অর্থনীতি এরই মধ্যে তাঁর পরিকল্পিত ‘ট্রাম্প নীতির’ সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রস্তুতি শুরু করেছে। নিজ দেশে ব্যবসা–বাণিজ্যে সুরক্ষা দিতে তিনি যেসব নীতি নেবেন বলে এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন, তার প্রভাব ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে পড়তে শুরু করছে।
চলতি সপ্তাহে কানাডায় একজন মন্ত্রীর পদত্যাগ সরকারের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে, এবং এটি দেশটির সরকার পতনের শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ যা পরিকল্পনা করেছিল, তার চেয়ে কমসংখ্যক বার সুদের হার কমাবে বলে জানিয়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি পৌঁছে গেছে রমরমা অবস্থায়। আর অ্যামেরিকাতে রপ্তানি পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে যেসব দেশ, তারা বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে।
অটোয়া থেকে শুরু করে ফ্রাঙ্কফুর্ট আর টোকিওতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন বছর শেষের বৈঠকে ব্যস্ত, যেখানে তাদের প্রধান লক্ষ্য ট্রাম্প জমানার আর্থিক নীতি ঠিক করার কাজে। এরই মধ্যে, বুধবার প্রত্যাশিতভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার কমিয়েছে। তবে, নতুন বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪৭তম প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর কী ঘটবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
জেঁকে বসা মূল্যস্ফীতি কমাতে ফেডারেল রিজার্ভের কর্মকর্তারা সুদের হার হ্রাসের যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন, সেখান থেকে তাঁরা যে খানিকটা পিছিয়ে এসেছেন কেবল তা–ই নয়, বরং তাঁরা আরও এক ধাপ এগিয়ে এখন চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। ফেডের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেছেন, ব্যাংকের কেউ কেউ ভাবছেন ট্রাম্পের পরিকল্পিত শুল্ক আরোপ, করহার হ্রাস এবং অভিবাসী নিয়ন্ত্রণ তাদের নীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশাবাদী যে আগামী বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হতে পারে। তবে তাঁরা এ–ও মনে করছেন যে পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। ফলে সুদের হার আরও কমানোর ব্যাপারে ‘সতর্ক’ থাকতে বলেছেন জেরোম পাওয়েল। তবে সে কারণে আবার শেয়ারের দাম কমতে শুরু করেছে।
ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল সুদের হার কমানোর বিষয়ে আরও সতর্ক থাকার পাশাপাশি বাজারের গতিবিধির ওপর গভীর নজর রাখতে বলেছেন। ফলে ২০২৫ সালে ফেড মাত্র একবারই সুদের হার কমাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান তার অতি নিম্ন নীতি সুদহার গত বৃহস্পতিবারও বহাল রেখেছে। ব্যাংক অব জাপানের এই সিদ্ধান্তের পেছনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নীতিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে, জাপানের রপ্তানি–নির্ভর অর্থনীতির জন্য ট্রাম্পের নীতি একটি হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে।
জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “জাপানের অর্থনীতি ও মূল্য পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে।”
গত সপ্তাহে জাপানি ব্যবসায়ীদের ওপর করা রয়টার্সের একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিমালা তাঁদের ব্যবসা কর্মকাণ্ডের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ব্যাংক অব জাপান সম্ভবত এই বিষয়টি আমলে নিয়েছে। উন্নত বিশ্বে জাপানই একমাত্র দেশ, যারা এখনো সংকোচনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে।
সর্বশেষ, ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার কমিয়েছে। এর আগে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) এবং ব্যাংক অব কানাডাও সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই দুই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষেত্রেও ২০২৫ সালে আরও কয়েক দফা সুদের হার কমানোর প্রত্যাশা রয়েছে, কারণ ইউরোপ এবং কানাডায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে।
তবে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্ড আবার সুদের হার কমাবেন কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না। তবে তিনি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার ঝুঁকির বিষয়ে জোর দিয়েছেন। বিশেষ করে ট্রাম্পের আমলে বাণিজ্য নিয়ে যে টানাপোড়েন হবে, তা নিয়ে তিনি বেশি উদ্বিগ্ন।
বিপর্যয়
ফেডের চিন্তায় হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছেন, তবে অটোয়াতে যা ঘটে গেল তার একেবারে কেন্দ্রেই ছিলেন এই রিপাবলিকান। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে দ্বিমত করে অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করেছেন, যা নিয়ে দুজনের মধ্যে বিশাল মতানৈক্য তা হলো, প্রতিবেশী দেশ অ্যামেরিকার পরবর্তী প্রশাসন কানাডার রপ্তানি পণ্যে সম্ভাব্য যে শুল্ক আরোপ করবে, তা কীভাবে মোকাবিলা করা যেতে পারে।
গত মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প সতর্ক করে বলেন, কানাডা এবং মেক্সিকো যদি অ্যামেরিকাতে অভিবাসী এবং ব্যথানাশক ওষুধ ফেন্টানিলের অনুপ্রবেশ সীমিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এই দুই দেশ থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড মনে করেন, নতুন এই শুল্কের হুমকি তাঁর দেশের জন্য বড় বিপদের কারণ হতে পারে।
অন্যদিকে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিটকয়েন নিয়ে যে উচ্ছ্বাস চলছে, তাতে পানি ঢেলেছেন ফেডের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল। ট্রাম্প চেয়েছেন যে বিটকয়েনের একটি কৌশলগত মজুত গড়ে তোলা হবে। কিন্তু পাওয়েল বলেছেন যে বিটকয়েনের মজুত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের কোনো আইনি কর্তৃত্ব নেই। তিনি আরও বলেন, এমন মজুত গড়ে তোলার জন্য আইনে পরিবর্তন আনার কোনো পরিকল্পনাও ফেডের নেই।
জেরোম পাওয়েল বলেন, ‘এটা এমন একটি বিষয় যা নিয়ে কংগ্রেস কাজ করতে পারে। কিন্তু আমরা ফেডে এ–সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের কথা ভাবছি না।’ তাঁর এই মন্তব্যের পর বিটকয়েনসহ ক্রিপ্টোসংক্রান্ত সম্পদের দামে অনেকটাই কমে যায়।