আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষ তো বটেই, নিরাপত্তা নেই খোদ পুলিশেরই। ডিএমপি কমিশনার দাবি করছেন, হাতে ভারী অস্ত্র আর পায়ে বুটের কারণে পুলিশ সদস্যরা ছিনতাইকারীদের সঙ্গে দৌড়ে পারছেন না। অন্যদিকে ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার করের বোঝা চাপিয়েছে জনগণের ওপর।
বাংলা নিউয নেটওয়ার্ক বিশেষ প্রতিবেদন
ব্যবসা বাণিজ্যের মন্দায় মানুষের হাতে অর্থের সংকটের কারণে বাংলাদেশের সরকারি কোষাগারে অর্থের টান, এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদেরকে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার উদ্যোগ। বাড়তি চাপ সামাল দিতে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার।
এমন পরিস্থিতিতে মানুষের ওপর আরেক চাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি। ‘খুনিদের অভয়ারণ্যে’ পরিণত হয়েছে দেশ; নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা বলে সংস্কার সংস্কার আওয়াজের মধ্যে মানুষের জীবন আর সম্পদের নিরাপত্তা আর খাওয়া পরাই অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।
পুরো দেশটাই যেন হয়ে গেছে মৃত্যুপুরি। থানার ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ওসির ঝুলন্ত মরদেহ, যে মরদেহের ছবি দেখে লোকে বলছে, ‘এটা আত্মহত্যা হতেই পারে না’, বাড়িতে ছুটিতে যাওয়া এসআইকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
পুলিশ বাহিনীই যখন নিরাপত্তাহীনতায় তখন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কী অবস্থা তা তো বোঝাই যাচ্ছে। খুলনার আওয়ামী লীগ সরকারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে কক্সবাজারে, বরিশালে যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে, নেত্রকোণায় শিক্ষককে ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এর মধ্যে ভরা মৌসুমে চালের দাম দিয়েছে লাফ, বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, তার হাতে কোনো জাদু নেই যে বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবেন। উল্টো শিল্প উদ্যোক্তাদের হৃৎস্পন্দন আরও বাড়িয়ে তুলে শিল্প কারখানায় গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ইউনিট থেকে ৭৫ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এসব নিয়ে সংবাদপত্র বা টেলিভিশনগুলোকে কোনো চুলচেড়া বিশ্লেষণ নেই, মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়ে আলোচনা নেই, সরকার করছে ‘সংস্কার, সংস্কার’।
ইকবাল হোসেন ভ্যাটের ৮ লাখ টাকা কোথায় পাবেন?
ঢাকার মগবাজারের দিলু রোডের মুদি দোকানি ইকবাল হোসেন। এক বছর আগেও দিনে বিক্রি হতো ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এখন তা নেমেছে ১৫ থেকে ১৬ হাজারে।
দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের এই দশার মধ্যে সরকারের রাজস্ব আদায়ে যখন টান পড়েছে তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত অনুযায়ী শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাটের হার বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করেছে। শুধু তাই না, ইকবাল হোসেনদের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়েছে এ কারণে যে, বলা হয়েছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ টাকা ছাড়ালেই তাকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।
যদি দিনে ১৫ হাজারও বিক্রি হয়, মাসে এই দোকানে বিক্রি দাঁড়ায় সাড়ে চার লাখ টাকা, বছরে হয় ৫৪ লাখ টাকা, এর ১৫ শতাংশ হারে তাকে ভ্যাট দিত হবে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা।
বিষয়টি বুঝিয়ে বলা হলে ইকবাল হোসেন বলেন, ‘এটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো হিসাবই রাখি না। আর কাস্টমারকে যদি ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে বলি, তারা আমার দোকানে কেন কিনবে? তারা তো যাবে স্বপ্ন, মীনা বাজারে। এসি দোকানে কিনবে।’
পাশে এক স্টেশনারি দোকানের বিক্রেতা বললেন, ‘সরকারের কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নাই। তারা বলতে গেলে কিছুই করছে না। তাহলে কেন ট্যাক্স বাড়াতে হলো?’
বাংলাদেশের সরকারগুলো রাজস্ব আদায়ে খুব বেশি কঠোর কখনও ছিল না। কর দেওয়ার ক্ষেত্রে ঐহিত্যগতভাবে অনীহা রয়েছে মানুষের মধ্যে। এ কারণে প্রত্যক্ষ করের চেয়ে ভ্যাট, আমদানি শুল্কের মতো পরোক্ষ করেই বেশি নির্ভর করে সরকারগুলো।
আইএমএফ রাজস্ব বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে আসছে বহু বছর ধরেই। কিন্তু জনগণের ওপর সম্ভাব্য চাপ কমিয়েও বছরে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ রাজস্ব বাড়িয়ে আসছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ইউনূস সরকারকে চাপ দিয়ে যে কাজ আইএমএফ করিয়ে নিতে পেরেছে, শেখ হাসিনা সরকারকে সেটা পারেনি। কেন সেটা পারেনি, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে সরকার পতন আন্দোলনে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়া মানুষেরাই।
এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগতে থাকা দেশে সরকারের এই সিদ্ধান্ত যে মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলবে, এ নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। এর মধ্যে আবার নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য বিক্রির ট্রাক সেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
গরিবের জন্য চিন্তা নেই?
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সারা বিশ্বে যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির সমস্যা দেখা দেয়, তখন বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষকে কিছুটা হলেও নিস্তার দিতে এক কোটি পরিবারকে টিসিবির কার্ড দেওয়া হয়। একেকটি পরিবারে গড় ৬ জন করে মানুষ থাকলে ছয় কোটি, অর্থাৎ দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষই এই সুবিধা পেত।
পরিবার কার্ডের মাধ্যমে একজন ক্রেতা মাসে সর্বোচ্চ দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি মসুর ডাল, এক কেজি চিনি ও পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারেন। ভর্তুকি মূল্যে দেওয়ার কারণে পরিবারের খরচ অনেকটাই কমতো।
ইউনূস সরকার ক্ষমতায় এসে ৪৩ লাখ কার্ড বাতিল করেছে। বলা হয়েছে অনিয়মের কথা। কিন্তু কী অনিয়ম, কারা দায়ী, সেসব বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যাই দেয়নি। আর এই কার্ড বাতিলের বিষয়টিও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জানানো হয়নি।
এর মধ্যে আবার শহরে নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রির ট্রাক সেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবার কবে শুরু হবে, সে বিষয়ে টিসিবি কিছু বলতে পারছে না, তারা তাকিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে। কিন্তু তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে, মজুত কোথায়? সরকারের খাদ্য মজুত নেমেছে তলানিতে।
ট্রাক থেকে একজন ভোক্তা দুই লিটার ভোজ্যতেল, পাঁচ কেজি চাল ও দুই কেজি মসুর ডাল কিনতে পারতেন। এতে একজন গ্রাহকের অন্তত ৩৫০ টাকা বা তার বেশি অর্থ সাশ্রয় হয়।
খুনের মহোৎসবে পুলিশের এ কেমন যুক্তি!
সরকারের পতনের পর থেকে যেন খুন, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মহোৎসব শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিরোধীরা সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশকে ‘উগান্ডা’ বলে কটাক্ষ করত। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন সত্যিই আফ্রিকার দেশগুলোর মতো হয়ে গেছে, তখন তারা আর ‘উগান্ডা’ বলে বাংলাদেশকে কটাক্ষ করছে না।
বৃহস্পতিবার শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ভেতর ওসি আল আমিনের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাটি আতঙ্ক তৈরি করেছে।
জানলার গ্রিলে কোনো একটা কিছু দিয়ে তার গলায় ফাঁস দেওয়া ছিল। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা দাবি করা হলেও ওসি আল আমিনের পা ছিল চেয়ারের ওপরে। এমনকি যে উচ্চতায় তার গলায় ফাঁস ছিল, তিনি দাঁড়ালেও মেঝেতে স্পর্শ করতেন।
ওসির এমন মৃত্যু নিয়ে আলোচনার মধ্যেই নেত্রকোণার দুর্গাপুর পৌর শহরের উকিলপাড়া এলাকার এস আই শফিকুল ইসলামকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক মাধ্যমে।
কিছুক্ষণ পর খবর আসে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সিগাল পয়েন্টের ঝাউবাগানে খুলনা সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানি টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা ছিলেন।
কিছুক্ষণ পর খবর আসে বরিশাল মহানগরে ২১ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার সাচিব রাজীবকে নির্মমভাবে কোপানো হয়েছে। তার পায়ের রগও কেটে দেওয়া হয়েছে।
রাজীবের যেসব ছবি পাওয়া গেছে, তা কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। কুচি কুচি করে কাটা হয়েছে তার পায়ের মাংস।
সেই নেত্রকোণাতেই শুক্রবার নিজ ঘর থেকে দীলিপ কুমার রায় নামে ৭১ বছর বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষকের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে মাথায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এর মধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে অসহায়ত্ব প্রকাশ করা হচ্ছে। ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী এ নিয়ে যে যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা নিয়ে শুরু হয়েছে হাস্যরস।
ছিনতাই প্রতিরোধে রাজধানীবাসীকে নিজের মোবাইল ও ব্যাগ নিজ দায়িত্বে নিরাপদ রাখার মাধ্যমে পুলিশকে ‘সহায়তা’ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
কিন্তু পুলিশ কেন পারছে না- ব্যাখ্যা দিয়ে সাজ্জাত বলেছেন, ‘আমার অফিসারদের কাছে বড় অস্ত্র থাকে, বুট পরা, ইউনিফর্ম পরা থাকে। ছিনতাইকারী থাকে খালি পায়ে বা একটা কেডস পরা। তার সাথে দৌড়ে পারাটা অনেক কঠিন।’
লোকজন কটাক্ষ করে বলছে, পুলিশকে নাঙ্গা পায়ে নামিয়ে দেওয়া হোক।