আগামী ৩১ ডিসেম্বর সংবিধানের কথিত কবর রচনার যে ঘোষণা আসছে, তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বলে আগেভাগে ঘোষণা দিল অন্তর্বর্তী সরকার। আর বিএনপিরও জানিয়ে দিয়েছে, তারা এই পদক্ষেপে একমত নয়। ছাত্র আন্দোলনের সামনে আরেক পরাজয় অপেক্ষা করছে?

আওয়ামী লীগের পতনের পাঁচ মাস পূরণ হওয়ার আগে আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পদক্ষেপে অন্তর্বর্তী সরকার অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।

আগামী ৩১ ডিসেম্বর সংবিধানের কথিত কবর রচনা করার কথা বলে ছাত্র আন্দোলন যে ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বলছে, সেটি সরকারের অবস্থান নয় বলে জানানো হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের দপ্তর থেকে।

গত ২৮ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই ‘থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বর, নাও অর নেভার’ বলে একটি বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক থেকে সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেওয়া আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও লেখেন ‘কমরেডস, নাও অর নেভার’ অর্থাৎ, বন্ধুরা, এখন অথবা কখনও নয়। পরে তিনি আবার লেখেন, ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’, তার মানে জুলাইয়ে গণ আন্দোলনের যে সূচনা হয়েছিল, তাকে বিপ্লব হিসেবে ধরে নিয়ে এর ঘোষণাপত্র দিতে যাচ্ছেন তারা।

নির্ধারিত দিনের দুই দিন আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে এসে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে ‘মুজিববাদী’ সংবিধান হিসেবে তুলে ধরে তার ‘কবর’ রচনা করার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ এর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে ‘নাৎসি বাহিনীর’ মত ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ঘোষণা করার কথা বলেছেন তিনি।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে, সেটি সংবিধান সংরক্ষণ এবং সংবিধান অনুযায়ী চলার অঙ্গীকারই করেছে। ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকারে আসা তিন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমও তাই করেছেন।

তখন থেকেই তরুণ উপদেষ্টাদের ‘গুরু’ ফরহাদ মজহারসহ অনেকেই বলে আসছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী শপথ না নিয়ে বৈপ্লবিক সরকার গঠন করা উচিত ছিল। তাদের দাবি, এটা না করায় সংবিধানের ফাঁদে পড়ে গেছে ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার।

সংবিধান এখনও বহাল থাকায় সরকারের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে বলা আছে, সংসদ ভেঙে দিলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। সেটা করা না গেলে বড়জোর আর ৯০ দিন সময় নেওয়া যায়। অর্থাৎ আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে।

আবার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার আদেশ এসেছে। এটি আরও লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি করেছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল যদিও বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারই তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু সংবিধানের বিধান অনুযায়ী এই সুযোগ আছে কি না তা নিয়ে আছে সন্দেহ।

কারণ, এই বিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। তিনি রাজি না হলে অন্য অনেক ধাপ পেরিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাউকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। তার মানে মুহাম্মদ ইউনূসের এই সরকারের প্রধান হওয়া অত্যন্ত কঠিন।

আবার উপদেষ্টা পরিষদ হতে হবে ১০ সদস্যের। তাদের কারও বয়স ৭২ হওয়া চলবে না আর সেই সরকারকে অবশ্যই ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সংবিধানে আর কোনো বিকল্পই নেই।

২০০৭ থেকে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন দিতে পেরেছিল, কারণ সে সময় রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করে সংবিধান স্থগিত করেছিলেন।

অর্থাৎ সংবিধান এখন সরকারের সদস্যদের জন্য যখন ভবিষ্যতে জবাবদিহিতার এবং শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে, সে সময় তারা সংবিধানের কবর রচনা এবং ‘বিপ্লবের’ ঘোষণাপত্রের কথা বলছে।

কিন্তু সরকার পতনের পরপর ছাত্র আন্দোলনের যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তা এখন আছে কি না, তা নিয়ে সমর্থকরাই ফেসবুকে প্রশ্ন তুলছে।

বিএনপি সরাসরি সংবিধান বাতিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যাদের বাধায় এর আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে পদ থেকে অপসারণে ব্যর্থ হয়।

দায় অস্বীকার সরকারের!

হাসনাত আবদুল্লাহ যেদিন সংবাদ সম্মেলন করে তাদের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন, একই দিন সংবাদ সম্মেলনে এসে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ও উপপ্রেস সচিবরা।

৩১ ডিসেম্বর জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দেওয়ার সঙ্গে সরকারের সম্পৃক্ততার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘এটাকে বেসরকারি উদ্যোগ হিসেবেই দেখছি। এটার সঙ্গে সরকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।’

উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, ‘এটা একান্তই শিক্ষার্থীদের বিষয়। এ বিষয়ে সরকার অবগত নয়।’

তাহলে কি ছাত্রদের ঘোষণাপত্র সরকার বিবেচনায় নেবে না?- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা যখন ঘোষণা দেবেন তখন আমরা দেখব তারা কী ঘোষণা দিল। যতক্ষণ পর্যন্ত এ ঘোষণাটা না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট না।’

মানবে না বিএনপি, স্পষ্ট বার্তা আব্বাসের

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস কোমল স্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে স্পষ্ট বার্তা দিয়ে দিয়েছেন যে, এসব সংবিধান কবর দেওয়ার বক্তব্য তারা মেনে নেবেন না।

তিনি বলেছেন, ‘শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে লেখা যে সংবিধান সেই সংবিধানকে যখন কবর দেওয়ার কথা বলা হয়, তখন কিন্তু আমাদের কষ্ট লাগে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এটা কী করছে? এইভাবে কথা বলাটা ঠিক হলো?’

আওয়ামী লীগকে কথায় কথায় ‘ফ্যাসিবাদী’ গাল নিয়ে আসা ছাত্র আন্দোলনের এসব কথাই যে আসল ‘ফ্যাসিবাদী’ সেই কথাও স্মরণ করান বিএনপি নেতা। বলেন, ‘এ ধরনের কথাগুলো ফ্যাসিবাদের মুখ দিয়ে আসে। কবর দিয়ে দেবো, মেরে ফেলব, কেটে ফেলব, ছিঁড়ে ফেলব… এই সমস্ত কথা ভালো কথা নয়।’সংবিধান পুনর্লিখনের যে কথা এর আগে উঠেছিল, তারও কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছিল মির্জা আব্বাসের তরফে। তিনি বলেছিলেন, ‘সংবিধান একটা রাফ খাতা নয় যে, ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।’

রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় যা খুশি না করা যায় না, সেই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে তিনি এবার বললেন, ‘যদি নতুন কোনো সংবিধান লিখতে হয়..তাও তো লিখতে হবে আগের অমুক সালের সংবিধান বাতিল করে এই সংবিধান জারি করা হলো।’

৭২ এর সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলার মানে যে মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করা, সেটি বোঝেন বিএনপির এই নেতা।

তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলেই এই সংবিধান। যদি মুক্তিযুদ্ধটা একাত্তরের আগেই অর্থাৎ একাত্তরের প্রথম দিকে শেষ হয়ে যেত তাহলে ৭১ সালের সংবিধান বলা হত।’

একাত্তরে যুদ্ধ করায় অন্যায় হয়েছে কি না সেই প্রশ্নও তুলেনে আব্বাস। পরিস্থিতি সেদিকে যাচ্ছে, তাতে এই প্রশ্ন উঠবে বলেও মনে করেন আব্বাস।

তিনি বলেন, ‘আমি জানি একটা পক্ষ বলবে যে, হ্যাঁ ওইদিন পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করে অন্যায় করেছেন।’

বিএনপির বিরোধিতায় ছাত্র আন্দোলনের পিছু হটা

শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি বলে মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর অক্টোবরের শেষে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি সামনে আনে ছাত্র আন্দোলন।

এই দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভও করে তারা। পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক কমিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে।

কিন্তু সংসদ বহাল না থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের কোনো আইনি সুযোগ নেই, আর বিএনপি তার অবস্থান স্পষ্ট করে বলে, তারা কোনো সাংবিধানিক সংকট চায় না।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ যদিও বলেছিলেন রাষ্ট্রপতিকে সরতেই হবে, কিন্তু তারা তা পারেননি। সেই চেষ্টা ভন্ডুল করে দেয় বিএনপি।

সরকার পতনের পঞ্চম মাসে দেশে যখন আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব, এমনকি মানুষের স্বাভাবিক চলার গতিও রুদ্ধ, সে সময় ইউনূস সরকার আর ছাত্র আন্দোলনের প্রতি মানুষের মোহ যে কেটেছে, সেটি এখন স্পষ্ট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here