মুক্তিযোদ্ধারা যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করতেন, সেটিকে জাতীয় স্লোগানে তালিকা থেকে বাদ দিতে উঠে পড়ে নেমেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিজয়ের মাসে সংবাদ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ উধাও। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বললেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
সরকারি চাকরিতে কোটার দাবি সামনে রেখে যে আন্দোলন শুরু হয়, সেই আন্দোলনের ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকাব’ বলে যে স্রোগান উঠে, তার পক্ষে অনেকেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের চার মাস পরে এসে আন্দোলনকারী ও অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্তের পর এখন স্পষ্ট হচ্ছে যে, সত্যিকার অর্থেই মুক্তিযুদ্ধকে অবজ্ঞা কেবল না, একে শত্রুজ্ঞান করা হচ্ছে।
দিন যত যাচ্ছে, সরকারের এই অবস্থান আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জাতীয় দিবস বাতিলের ধারাবাহিকতায় এবার মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনী ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান বাতিল করা হলো আদালতের মাধ্যমে। অথচ দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর হাই কোর্টই এই আদেশ দিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারে থাকতে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে দেশের সংবাদ মাধ্যম আর রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ, যুদ্ধকালীন নানা ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরত। কিন্তু এবার কিছু নেই। সরকারের তরফে একটিবারের জন্যও মুক্তিযুদ্ধ আর বিজয়ের কথা উচ্চারণ করা হয়নি।
এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করা জামায়াত ও তার সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের আলবদর নেতাদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, তাদেরকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় প্রায়ই নানা সময় বলেছে, ২১ বছর দেশে জয় বাংলা স্রোগান নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা করা হয়েছে, জাতির পিতাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও না দেখে কোনো কিছুতে বিশ্বাস করতে না চাওয়া বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই সেসব বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে পাল্টা প্রশ্ন রাখে, তাই হয় নাকি?
তবে সে সময়ে ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা পত্র পত্রিকায় না থাকলেও বর্তমান সময়ে সামাজিক মাধ্যমের কারণে আটকানো যাচ্ছে না।
৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিচিহ্ন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আক্রমণ হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে, তার ভাস্কর্য, ম্যুরাল ভেঙে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ও জাদুঘরের মধ্যে কয়টি অক্ষত আছে, সেটিই এখন গুনা যাবে।

একটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস অতীতের সব কিছু রিসেট বাটন পুশ করে মুছে দেওয়ার কথা বলেছেন। পরে সমালোচনার মুখে কথা ঘুরালেও তার সরকার ও সঙ্গে থাকা মানুষদের কর্মকাণ্ডে প্রমাণ হচ্ছে যে রিসেট বাটন পুশ েআসলে মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দেওয়ার চেষ্টাই।
মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান শুনলেই আক্রমণ
২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল হাই কোর্ট। এই স্লোগানেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানপন্থিদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। তবে যুদ্ধ শুরুর পর কয়েক মাস কেবল তারা সেভাবে সাফল্য পায়নি এই যা।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের যে প্রবাসী সরকার শপথ নেয়, তার ভিডিও এখনও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ আর ‘তোমার নেতা, আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানই তুলেছিলেন।

‘জয় বাংলা’কে তখন শত্রু জ্ঞান করেছে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান সরকার আর টিক্কা খানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার। তাদের পাশে ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো। ছিল আরও কিছু ছোট ছোট দল।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর একইভাবে ‘জয় বাংলা’কে শত্রুজ্ঞান করছে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। সঙ্গে আছে একাত্তরের শত্রু জামায়াতে ইসলামী, তার বর্তমান ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে গত ২ ডিসেম্বর আবেদন করে ইউনূস সরকারের বেছে নেওয়া আইন কর্মকর্তা তথা সরকারি আইনজীবী তথা রাষ্ট্রপক্ষ।
এই আবেদন গ্রহণ করে জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করে দেওয়া হাই কোর্টের রায় স্থগিত করেছে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ আপিল বিভাগ।
দেশের প্রধান সংবাদ মাধ্যমগুলো এই সংবাদটি প্রকাশ করলেও আশ্বর্যজনকভাবে রাষ্ট্রপক্ষ কোন যুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনীকে জাতীয় স্লোগান করার বিরোধিতা করছে, তা আর লেখছে না।
আদালতের এই আদেশের আগ পর্যন্ত জয় বাংলা জাতীয় স্রোগানই ছিল। তবু এই স্লোগান দেওয়ার কারণে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এক সিভিল সার্জনকে। তার নাম জালাল উদ্দিন।
গত ২৪ অক্টোবর বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই সিভিল সার্জন উদ্দিন তার বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করেন।
এই ঘটনায় তেলেবেগুনে ক্ষেপে উঠে সরকার। জালালকে প্রথমে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করা হয়। আর ৪ নভেম্বর তাকে চাকরি থেকে অবসরে পাঠানো হয়।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে লেখা হয়, ‘জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
আর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ীতে শিক্ষকদের এক কর্মসূচিতে একজন শিক্ষক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার পর মারমুখো হয়ে উঠেন বিএনপি-জামায়াতপন্থিরা। সেই শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়।
গত ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক মুক্তিযোদ্ধা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার পর তাকে বেধরক মারধর করে গায়ের জামা ছিড়ে ফেলা হয়। পরে তাকে দেয়া হয় পুলিশে। দুই দিন পর পুলিশ তাকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায়।
২০১৩ সালে গণজাগরণমঞ্চের আন্দোলনের সময় অবশ্য ‘জয় বাংলা’র পুনর্জাগরণ হয় দেশে। সে সময় প্রশ্ন উঠে, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান, তাদের সবাই কেন মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনী ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন না।
তখন অনেক বামপন্থি নেতা আর বিএনপির নেতারা সংবাদ মাধ্যমে দাবি করেন, আওয়ামী লীগ এই স্লোগান দখল করে রেখেছে, তারা ভাগ দেয় না।
সংবাদ মাধ্যমে বিজয়ের মাস উধাও!
গত ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। লেখেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাসে অধিকাংশ পত্রিকা ও টেলিভিশনগুলোর ভূমিকা দেখছি । গত বছরের বিজয়ের মাসের, আর এবারের ভূমিকা দেখুন । ছি!’

প্রিন্সের এই বক্তব্য অসত্য নয়। প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহ জাতীয় দৈনিকগুলোতে ছাপা হয়ে আসছে আওয়ামী লীগ শাসনামলে। কখনও কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও প্রচার হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের আগেকার ঘটনাপ্রবাহ, স্মৃতিচারণ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
এখন হাতে গোনা দুই একটি সংবাদ মাধ্যমে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানির মত’ ছোট করে কিছু ছাপা হলেও তা চোখে পড়ার মতো জায়গায় থাকে না বললেই চলে।
প্রিন্সের মত অনেকেই এখন এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। কিন্তু সরকারের তরফে কোনো বক্তব্য নেই।
সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে হাসনাত আবদুল্লার ভাষণ!
বরং বিজয়ের মাসে সরাসরি একাত্তরের খুনে বাহিনী আলবদরের নেতাদের পক্ষে স্লোগান ধরেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের পক্ষে লড়াই করা মিলিশিয়ারা আত্মসমর্পণ করেছিল, ৫৩ বছর পর সেই উদ্যানে বিজয়ের কেবল চার দিন আগে সমাবেশ করে তিনি আলবদর নেতাদেরকে ‘আলেম’ আখ্যা দেন।

একাত্তরে আলবদর বাহিনীর প্রধান ও বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রধানের দায়িত্ব পালন করা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী, রাজাকার বাহিনীর সদস্য আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়কে ইঙ্গিত করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘একাত্তরকে পুঁজি করে যাদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা হয়েছে, যাদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে, যেই পরিবারগুলোকে মানুষের সামনে লজ্জিত করা হয়েছে সেই পরিবারগুলোর ইজ্জত ফিরিয়ে দিতে হবে।’
অর্থাৎ আলবদর নেতাদের ‘ইজ্জত’ নষ্ট করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের ‘ইজ্জত’ ফিরিয়ে দেবেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
এখানিই তিনি থেমে থাকেননি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জড়িতদের বিচার করার ঘোষণাও দিয়েছেন। বলেছেন, , “প্রশ্নবিদ্ধ এক বিচারের মাধ্যমে আমাদের দেশের আলেমগুলোকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। আমরা এই বিচার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত দুনিয়ার কোনো শক্তি নাই আমাদের রাজপথ থেকে উৎখাত করবে।’