সৈয়দ ইফতেখার হোসেন, লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অসাংবিধানিক ইউনুস সরকার চার মাস পার করলো। কেমন গেলো ইউনুসের এই চার মাস সে প্রশ্ন তো করা যেতেই পারে। এমন প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হতে পারে এই চার মাসে ইউনুস ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশকে কম পক্ষে ৪০ বছর পিছিয়ে নিয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতি এখন গভীর অন্ধকূপে পতনোন্মুখ।
দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। পুলিশের পরিবর্তে বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনী দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে পালন করার চেষ্টা করছে যা তাদের কাজ নয়। তাদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে তাদের বিচারিক ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণে তারা তাদের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। দীর্ঘ দিন তারা এই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করে অনেকটা ব্যর্থ হওয়ার কারণে তাদের অবস্থা এখন অনেকটা গ্রাম পুলিশের মতোই হয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা হটাও আন্দোলনের শিকার হয়ে প্রায় তিন হাজারের বেশি পুলিশ প্রাণ হারিয়েছে, তাদের হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ৪০০ থানায় অগ্নিসংযোগ করে সম্পূর্ণ ভস্মিভূত করা হয়েছে। কয়েকশত অস্ত্র লুঠ হয়েছে । এই সব কাজ যে তথাকথিত সম্বনয়করা করেছে তা তারা পরবর্তীকালে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে। এদের বেশিরভাগই ছাত্র ছিল না। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তারা ছিল বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য। যারা কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে শেখ হাসিনা হটাও আন্দোলনের উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশ পুলিশও কাজে যোগ দেয়নি।
দেশের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা ইউনূসের দোসরদের উস্কানিতে দেশে ধর্মীয় উন্মদনা সৃষ্টি করে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক সমস্যার সৃষ্টি এবং যার প্রধান শিকার সংখ্যা লঘু সনাতন ধর্মের মানুষ। তাদের দুর্দশার প্রতি ড. ইউনূসের সরকারের উদাসীনতা বাংলাদেশের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে মিলে যায়। ইউনুস সেদিন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে মত বিনিময়ের সময় এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন তিনি এই বিষয়ে শুনেছেন তবে তাঁর কাছে নাকি এর কোনো প্রমাণ নেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে। আইনের শাসন গত চার মাসে তলানিতে ঠেকেছে। সংগঠিত হামলার মধ্যে রয়েছে আটক রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং সাংবাদিকরা । আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় তারা আদালতে জামিনের জন্য আসতে অক্ষম। আদালতে এলে তারা বিএনপি জামায়াতের আইনজীবীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। উচ্চ আদালতের কোনো রায় আইনজীবীর পছন্দ না হলে বিচারপতির প্রতি ডিম ছোড়া হচ্ছে। ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুকে বিচারের জন্য আদালতে আনা হলে তার পক্ষে আদলতে দাঁড়নোর কোনো আইনজীবী পাওয়া যায় না কারণ জামায়াত বিএনপির আইনজীবীরা হুমকি দিয়েছে কেউ তাঁর পক্ষে আদালতে দাঁড়ালে তাঁকে খতম করে দেওয়া হবে। ১১ ডিসেম্বর, বুধবার, ঢাকা থেকে একজন আইনজীবী তার পক্ষে আদালতে জামিন প্রার্থনা করতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জামায়াত বিএনপি’র আইনজীবীদের বাধার মূখে জামিন পিটিশন দাখিল করতে পারেননি।
বিগত চার মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে, বিশেষ করে সনাতন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের কারণে। এটা কল্পনা করা কঠিন যে ঐতিহাসিকভাবে এবং বিশেষ করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে যে দুটি দেশ মিত্র ছিল, তারা আজ তাদের সম্পর্কের অভাবনীয় নিম্নগামী সাক্ষী হতে হচ্ছে। বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা স্থগিত রয়েছে এবং কলকাতা থেকে খবর এসেছে যে, কোনো কোনো হাসপাতালে এরই মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশও ভারতীয়দের জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করেছে। ভারতের কোনো কোনো জেলায় হোটেলগুলোতে বাংলাদেশিদের থাকার জায়গা হচ্ছে না। অন্য দিকে যে দেশটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা আর তিন লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে সেই পাকিস্তান নামক দেশটিকে ইউনুস বুকে টেনে নিয়েছে। তাদের জন্য ভিসা প্রাপ্তি সহজ করেছে। এই ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তান বা তাদের পাশের তালেবানি রাষ্ট্র আফগানিস্তান হতে জঙ্গী ও পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সদস্যদের আসা সহজ হলো। এরই মধ্যে গত সোমবার ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্ত্রি রুটিন সফরে ঢাকা এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে এই দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, নির্যাতন, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভারতের অন্তোষের কথা বলে গিয়েছেন। উত্তরে পররাষ্ট্রি উপদেষ্ট বলেছেন এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় ।
হিন্দুদের উপর নানা ধরণের নিপিড়নের কারণে এরই মধ্যে চট্টগ্রাম ও রংপুরে তারা বড় ধরণের প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিল। ১৩ ডিসেম্বরও একটি সমাবেশ খুলনায় হওয়ার কথা ছিল তা তারা চাপে পরে স্থগিত করেছে। পূর্বের সমাবেশগুলোতে তারা ঘোষণা করেছে তাদের নিজ দেশ বাংলাদেশ ছেড়ে তারা কোথাও যাবে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই দেশের জন্য রক্ত দিয়েছে। বাড়ির মহিলারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে নিগৃত হয়েছে।
বিগত চার মাসে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছে দেশে এমন একটি অরাজক অবস্থার মধ্যে মুহাম্মদ ইউনূসের শাসন কেনো কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে তাঁর সরকারি বাসভবন যমুনার বাইরে যে একটি বাংলাদেশ আছে তা হয়তো তিনি ভুলে গিয়েছেন। যেখানে ৫ আগস্টের পর তাঁর মৌলিক দায়িত্ব ছিল ১৫ বছরের নিরবচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ শাসন থেকে সুবিধাভোগী দুর্নীতিবাজদের বিচার করা এবং বাংলাদেশকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করা তা তিনি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি শুধু ১৫টি তথাকথিত সংষ্কার কমিশন তৈরি করে নিজের দায়িত্ব ছেড়েছেন। যে ব্যক্তিটি ৪০ বছর ধরে মার্কিন নাগরিক তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সংবিধান সংষ্কারের পরামর্শ, যা করার কথা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। এই ব্যক্তির একমাত্র যোগ্যতা তিনি মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। এমন সব অদূরদর্শী ব্যবস্থার কারণে ইউনূস এবং তার উপদেষ্টারা বাংলাদেশকে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার ঢাকা থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে এই নৈরাজ্যই বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে চিহ্নিত করেছে।
দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন কতদিন এই অসাংবিধানিক সরকারের মেয়াদ? এই নিয়ে যে যার সুবিধামতো উত্তর দেয়। জামায়াত, যাদের জনগণের সমর্থনে ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা কখনো ছিল না, এখনো নেই, তারা চায় ইউনূস শেখ হাসিনার নির্বাচিত সরকারের বাকি মেয়াদ শেষ করুক। তারা নিঃশব্দে তাদের অনুগামীদের সরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে। দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো তাদের দখলে। আমলাতন্ত্র তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে । চারিদিকে চলমান নৈরাজ্যের সুযোগ নিয়ে জামায়াত ক্রমশ তাদের অবস্থান সুসংহত করছে। দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছু থেকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করার একটি জোরালো কর্মসূচি বাস্তবায়নে তারা ব্যস্ত। এই ব্যাপারে তাদের সার্বিক সহায়তা করছে ইউনুস সরকার। সম্প্রতি লন্ডন সফরকালে জামায়াত প্রধান ১৯৭১ সালের ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে বলেন সেই সময় জামায়াত বা তাদের অঙ্গসংগঠন সম্পর্কে কোনো অপরাধের বস্তুনিষ্ট প্রমাণ থাকলে দলটি বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত আছে। অথচ তাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালিবিরোধী অপরাধের অসংখ্য প্রমাণ দেশে ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে আছে। জামায়াত প্রধান ভুলে গিয়েছেন যে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য তাদের অনেক নেতাকর্মী বিগত সরকারের সময় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল।
দেশের অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি, যারা আওয়ামী লীগবিহীন একটি নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে তারা দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের একটি রোড ম্যাপ চায়। তারা ২০০৬ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে। বাম দলগুলো এ ব্যাপারে তেমন একটা সোচ্চার নয় কারণ তারা কখনো এই দেশে কোনো নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা দেখে না। জামায়াত যেমন ইউনূস বা বিএনপির কাঁধে চড়ে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে ঠিক একইভাবে বাম দলগুলোও বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের শরিক হয়ে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে। সেনাবাহিনী মনে করে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ করা উচিৎ। ইউনুসের বিভিন্ন উপদেষ্টা বিভিন্ন ধরণের মত পোষণ করেন। কেউ বলেন ১৮ মাস কেউ বলেন ২০২৫ সাল। আর ড. ইউনুস ঘোষণা করেছেন তিনি ঠিক করবেন তিনি কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন। সোমবার ড. ইউনুসের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতে কর্তব্যরত ইউরোপী দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ করতে গেলে তারা নির্বাচন বিষয়ে জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন চলতি মাসেই এই ব্যাপারে ঘোষণা হতে পারে।
বিগত চার মাসে ইউনূসের অন্তর্র্বর্তী সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসকে মুছে ফেলার অভিপ্রায় বাস্তবায়নের ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর সরকারের পৃষ্ঠপোষকরা সংবিধান থেকে জাতীয় শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ মুছে ফেলার জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। ইতোমধ্যে অনেকটা সরকারের নির্দেশে দেশের উচ্চ আদালত জাতী শ্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’ বলা পূর্ব বর্তি সরকারের আদেশ স্থগিত করেছে । কয়েক সপ্তাহ আগে, ইউনূসকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে একজন যুবকের ভূমিকা, রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি টেনে নামিয়েছিলেন। সেই যুবক বিশ^ স্বীকৃত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরিরের একজন সক্রিয় কর্মী মাহফুজ আলম। ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন বা শেখ হাসিনা হঠাও আন্দোলনের কোথাও তার প্রকাশ্য ভূমিকা চোখে পরেনি। প্রথমবারের মতো তাঁকে ইউনুস যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন এই ব্যক্তি দীর্ঘ দিন অত্যন্ত সুচারুভাবে (মেটিকুলাসলি) পরিকল্পানা করে বাংলাদেশের এই পরিবর্তন এনেছে। শেখ হাসিনা আন্দোলন হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা ছিল না। এতে সবাই এমনকি দেশে অবস্থানরত কথিত সমন্বয়করাও অবাক হয়েছিলেন। ইউনূসের এই বক্তব্য প্রমাণ করে দেশে যে সরকার হঠানোর দীর্ঘদিনের একটি পরিকল্পনা হচ্ছিল তা তিনি জানতেন আর তার সঙ্গে তার সক্রিয় সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের মতো ব্যক্তিরা যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল তারই একটি ইউনুসের এই বক্তব্য অনু স্মারক হিসেব দেখা যেতে পারে।
মাহফুজ যেদিন দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিলেন তার কয়েক মিনিট পর বঙ্গভবনের দরবার হলে ঝুলানো বঙ্গবন্ধুর ছবিটি নিজ হাতে নামিয়ে ফেলেন। অথচ তিনি যে সংবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নিয়েছিলেন সেই সংবিধানেই জাতির পিতা শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশ এই প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে না। সামরিক কুচকাওয়াজ বাতিল করা হয়েছে। কোন আলোচনা অনুষ্ঠান হবে না । এমনটি শুধু মাত্র কোভিডকালে হয়েছিল। বর্তমান উপেদেষ্টা সরকার তাদের নতুন মিত্র পাকিস্তানকে একাত্তরের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় না।
দেশজুড়ে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দূর্বিষহ করে তুলেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশে উপনিত হয়েছে এই চার মাসে। পথে ঘাটে মানুষ প্রকাশ্যে বলছে ‘আগেই ভালো ছিলো’। গার্মেন্টস ও পরিবহন খাতে দিন দিন অসন্তোষ বাড়ছে। অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে চার মাসে কয়েক লাখো মানুষ বেকার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোষাক রপ্তানি আশংকাজনকভাবে কমেছে। অর্ডার যাচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানে। দেশে ভেতরের বা বিদেশের কোনো বিনিয়োগ নেই। চলে যাচ্ছে অনেক বিনিয়োগকারি । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃংখলার রাজত্ব চলছে, সহিংসতার পর শিক্ষকরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের শত শত সহকর্মীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে উচ্ছশৃঙ্খল শিক্ষার্থীরা। চার মাসের মাথায় শুধু রাজধানী ঢাকায় সাতটি কলেজ বন্ধ রয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল তারা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে না।
দেশের মিডিয়া বর্তমানে অনেকটা পোষা বিড়ালের মতো আচরণ করতে বাধ্য হচ্ছে কারণ জনতার সহিংসতার, যাকে বলা হয় ‘মব জাস্টিস’ তাকে মিডিয়া ভয় পেতে বাধ্য হয়েছে। দেশের প্রথম সারির দৈনিক ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোকে আওয়ামী লীগপন্থী এবং ভারতপন্থী বলে অভিযুক্ত করে উন্মত্ত জনতা আক্রমণ করেছে একাধিকবার। অথচ এই দুটি পত্রিকা সব সময় শেখ হাসিনা সরকারের বড় সমালোচক ছিল। কয়েক ডজন সাংবাদিক হয় কারাগারে বা হত্যা মামলার আসামি হয়ে পলাতক। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মিডিয়া বিশ্বের সবচেয়ে আতংকগ্রস্ত মিডিয়া। ইউনুস সরকারের সমালোচনামূলক মন্তব্য এবং সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে সম্পাদকরা ভয়ে কুঁকড়ে থাকেন।
রাজনীতি ও ইতিহাসের বিচারে বাংলাদেশ ৫ আগস্ট থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত। মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক কাঠামোগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে; বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, ১৯৯৪ সাল থেকে যা স্মৃতির জাদুঘর, যাকে বলা হয় ‘বাংলাদেশের বাপের বাড়ি’ যেদিন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছিল সেদিনই আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে। একইদিন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এর বিরুদ্ধে ইউনুস সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্র্বর্তীকালীন প্রশাসনের কেউ কখনো এ ধরনের নাশকতার নিন্দা পর্যন্ত করেনি। পরিবর্তে, ইউনূস সরকার ইতিহাস-বিরোধী মোড়ে চলে গিয়েছে: ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর মূল ভাষণের বার্ষিকী এবং ১৫ই আগস্টকে তাঁর হত্যার বার্ষিকীকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালন বন্ধের আদেশ দেয়। অথচ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ইউনেস্কো বিশ্বের ইতিহাসে একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে কেন আগুন লাগানো হয়েছিল তা ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জানতে চাইলে ইউনূস প্রশ্নটি শুধু এড়িয়েই যাননি তিনি বেশ পরিষ্কার ভাষায় সঞ্চালককে পরামর্শ দেন সেই সব অতীতের কথা ভুলে গিয়ে বর্তমানকে নিয়ে কথা বলতে। তিনি আরো বলেন ৫ আগস্ট রিসেট বোতাম টিপে দেয়া হয়েছে, ইতিহাসকে নতুনভাবে শুরু করতে। অন্য কথায়, তাঁর দৃষ্টিতে, অতীত কোনো ব্যাপার ছিল না। বিবৃতিটির পর দেশে এবং এর বাইরে ইউনূস অনেক নিন্দা ও সমালোচনার কারণ হয়েছিলেন।
গত চার মাসে ড. ইউনুসের অন্যতম কীর্তি হলো তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে কর ফাঁকি দেওয়ার মামলায় যে দণ্ডিত হয়েছিলেন তা থেকে তিনি শুধু অব্যাহতিই নেননি, সরকারকে ৬৬৬ কোটি টাকা পরিশোধের যে হকুম হয়েছিল তা থেকে তিনি অব্যাহতিও নিয়েছেন এবং ২০২৯ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংককে করমুক্ত ঘোষণা করা ব্যবস্থা করেছেন । অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ট্রাস্টের (৩২ নম্বর বাড়িও অর্ন্তভূক্ত) উপর কর ধার্য করেছেন। এটি তার প্রতিহিংসার এক ন্যক্কারজনক নজির হয়ে থাকবে। একই সময়ে ১৮ জুলাই থেকে ৮ আগষ্ট দেশে সব ধরেণর হত্যাকান্ডের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের দায় মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর অন্যতম কারণ যারা এই সব হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিল তারাই তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ।
বাংলাদেশের সার্বিক সংকট বর্তমানে দেশটিকে এক ভয়াবহ বির্পযয়ের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। যে দেশটি ২০২৬ সাল নাগাদ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সেই দেশ ১৯৭২ সালে যে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল সেখানেই দ্রুত ফিরে যাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি চলমান থাকলে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশ অচিরেই হয়ে যেতে পারে সিরিয়া বা সোমালিয়া অথবা আফগানিস্তান । ইতোমধ্যে দেশে হিযবুত তাহরির, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, হুজি, আইসিসের মতো বাংলাদেশের ভিতর তাদের ভিত সরকারি পৃষ্টপোষকতায় পাকাপোক্ত করেছে ।
ইউনূসের অসাংবিধানিক সরকারের চার মাস পরেও আরেকটি বাস্তবতা আছে যা উপেক্ষা করা যায় না। সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ৫ আগস্ট যখন তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয় সেনাবাহিনী তখন তাকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার এবং তার পদত্যাগ জমা দেওয়ার সুযোগ দেয়নি যা সাংবিধানিকভাবে করাটি আবশ্যিক ছিল। আর সংবিধানের আলোকে একজন প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদে ইস্তফা দিলেও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করবেন। সংসদ বাতিল করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ প্রয়োজন যা সংসদ বাতিলের সময় নেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনকে অপসারণের চেষ্টা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নিজ পদে ইস্তফা দিলে সাংবিধানিকভাবে সংসদের স্পিকার পরবর্তী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এরই মধ্যে সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী তাঁর পদে ইস্তফা দিয়েছেন। ডেপুটি স্পিকার কারাগারে। পরিস্থিতি বেশ জঠিল।
এরই মধ্যে ড. ইউনুস ও তাঁর সভা পারিষদদের বিরুদ্ধে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জোরপূর্বক অসংবিধানিকভাবে একটি দেশের নির্বাচিত সরকারকে জোর পূর্বক হঠিয়ে ক্ষমতা দখলের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এই অভিযোগের নিষ্পত্তি হলে ড. ইউনুসের জীবনের আর একটি ধূসর অধ্যায়ের যাত্রা শুরু হতে পারে। বিপদে পড়তে পারেন তাঁর দোসররা। ইউনুসের শাসনের চার মাসের মাথায় দেশের মানুষের সার্বিক শান্তির আকুতিটা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি জোরালো।