সংবিধানে বলা আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন করবে ৯০ দিনে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারই হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদি তাই হয়, তাহলে ভোট ২০২৫ এর শেষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
বাংলা নিউয নেটওয়ার্ক বিশেষ প্রতিবেদন
হাই কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরার পর রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার একটি গভীর আইনি সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নাম বদল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা হবে। সেটি সেটা সুপ্রিম কোর্ট নির্ধারণ করবেন, বলছেন তিনি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকান নিউইয়র্ক বাংলা নিউয নেটওয়ার্ককে বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে অ্যাকটিভ হয়ে গেছে।’
তাহলে তিন মাসে নির্বাচন করতে হবে কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হিসাব করলে তাই আসে।’
এখনও আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়নি, তবে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধানগুলো আছে, তাতে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু ইউনূস যে পরিকল্পনা করছেন, তাতে তিনি আরও এক থেকে দেড় বছর সময় নিতে চান। এই বাড়তি সময় সংবিধান অনুমোদন করে না।
মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, ‘কেয়ারটেকার সরকার যেহেতু পুনর্বহাল হয়ে গেছে, এই সরকারের মেয়াদ তো ৯০ দিন, তাহলে নির্বাচন এর মধ্যেই হতে হবে। অবশ্য পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে আরও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারব।’ পূর্ণাঙ্গ রায় কবে প্রকাশ হবে, সেই বিষয়ে অবশ্য সর্বোচ্চ আদালত থেকে কিছু জানানো হয়নি।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এরপর এই সরকারের অধীনে মোট তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন ও ২০০১ সালের ১ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়কের নির্ধারিত মেয়াদেই নির্বাচন হয়।
২০০৭ সালের নবম সংসদ নির্বাচন বাতিল হয় আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ায়। এর আগে সে সময়ের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদত্যাগ করলে শপথ নেয় ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা ক্ষমতায় থাকে প্রায় দুই বছর। নির্বাচন দেয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর।
৯০ দিনের মেয়াদ দুই বছর টেনে নেওয়ার পেছনে কারণ ছিল, পুরোটা সময় জরুরি অবস্থা জারি ছিল। ফলে সে সময়ে সংবিধান কার্যকর ছিল না। কিন্তু এখন সংবিধান বলবৎ আছে, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার সেই সংবিধান মেনে চলা ও সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করেই গত ৮ আগস্ট শপথ নিয়েছেন।
কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন আগামী বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন হতে পারে, তাও এই সময়ে হবেই, এমন নিশ্চয়তা তিনি দেননি।
প্রশ্ন হল, সংবিধান বলবৎ রেখে এই বাড়তি সময় ইউনূস সরকার কীভাবে নেবে? যশ্মিন দেশে যদাচারের আচরণ যদি তারা করে, তাহলে সেটি ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির হয়ে থাকবে।
তবে বিএনপি সরকারের এই যা খুশি তাই করার ইচ্ছা যে মানবে না, সেটি স্পষ্ট করেছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ভোটাধিকারের দাবিতে ৫ আগস্টের মতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবার মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারের কোনো নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি নেই, সরকার পতনের পর হামলায় পুলিশ বাহিনীর শক্তি ক্ষয়ে গেছে, এই অবস্থায় বিএনপি যদি নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামে তাহলে তাদেরকে ঠেকাবে কে? ইউনূস সরকার যদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা জাতীয় নাগরিক কমিটিকে লেলিয়ে দেয়, তাহলে আবার সংঘাত সহিংসতায় ঢুকবে দেশ।
মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘সরকারকে সব সময় সমর্থন করবে না বিএনপি। ভোট ছাড়া ক্ষমতায় থাকতে চান যদি জনগণ তো সহ্য করবে না। জনগণের দল হিসেবে বিএনপি কেন সহ্য করবে?‘
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে, তা দেশের জন্য নিরাপদ হবে, সরকারের জন্য নিরাপদ হবে, অর্থনীতির জন্য নিরাপদ হবে। জনগণ মনে করবে জবাবদিহিমূলক সরকার আছে তখন তারা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবে।’
গত ৮ আগস্ট শপথ নেওয়া ইউনূস সরকার এতদিন সময় নেবে, সেটি বিএনপি বুঝতেই পারেনি। দলের যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম দুই থেকে তিন মাস সময় বুঝি নেবে। কেয়ারটেকার সরকার তো ৯০ দিনে ইলেকশন করে। আইন কানুন সব সংস্কার করে এর মধ্যে। এখন আমাদের মনে হচ্ছে এই সরকারের মধ্যে আওয়ামী লীগের কিছু দোসর রয়ে গেছে। তারা চায় এই সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য। এ জন্য তারা এসব দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা দিচ্ছে।’
‘জনগণকে যদি সন্ত্রস্ত রাখতে পারে, তাহলে এই সরকার ব্যর্থ হবে। ব্যর্থ হলে পতিত সরকার পলাতক সরকার ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারে’- এই আশঙ্কার কথাও বলেন তিনি।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অবশ্য নির্বাচনের ধার ধারছেন না, তার বক্তব্য হল, আন্দোলনে এত মানুষ নাকি কেবল নির্বাচনের জন্য জীবন দেয়নি।
ইউনূস সরকার কি সবার জন্য সমান?
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। যদি আওয়ামী লীগ অংশ নেয়, তাহলে ইউনূসের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো দল নিরপেক্ষ সরকারের চরিত্র বজায় রাখতে পেরেছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
এর কারণ, সরকারের উপদেষ্টারা প্রতিদিনই আওয়ামী লীগকে গালাগাল করছেন, দলটির রাজনীতি প্রতিহত করার কথাও বলছেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দ ব্যবহার ছাড়া কথাই বলেন না, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন কেবল ফাঁসিতে ঝুলতে’।
এমন একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা সবার জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করবে না, এর ফলে এই নির্বাচনও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, যে সংকটে আওয়ামী লীগ ছিল ২০২৪ থেকে। তার মানে রাজনৈতিক সংকট থেকে বাংলাদেশ বের হতে পারবে না, এখানে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় থাকবে।
তত্ত্বাবধায়ক ফেরানোর আদেশই কি বৈধ?
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেওয়ার বছরে ২০১১ সালে নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে আওয়ামী লীগ সরকার।
১৩ বছর পর গণ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর উচ্চ আদালতে নতুন মুখ আসার পাল্টে যাচ্ছে সব রায়। তাই বলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আদেশ হাই কোর্টে বাতিল হবে, এমন নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হলো বাংলাদেশ।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ১৭ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে।
প্রশ্ন হল, সুপ্রির কোর্টের আপিল বিভাগ যে সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে, সেই সরকার ব্যবস্থাকে অধস্তন আদালত কীভাবে বৈধ ঘোষণা করতে পারে।
সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করার পরেও সংসদ চাইলে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাস করতে পারত, কারণ সংসদ সার্বভৌম। সেটি না হলে উচ্চতর আদালতের রায় অধস্তন আদালত দিয়ে বাতিল করার বিষয়টি কীভাবে সম্ভব- এই প্রশ্নে বহু বছর উচ্চ আদালত নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করা একজন প্রতিবেদক বলেন, ‘এটা তো কোনোভাবেই হতে পারে না। এরা গায়ের জোরে যা খুশি করছে। এগুলো ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ হবে।’
সেই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলেন, ‘যে রিট আবেদনটি করা হয়েছে, সেটি তো হাই কোর্ট বেঞ্চের শোনারই কথা ছিল না, এখানে রিভিউ আবেদন করতে পারত আপিল বিভাগে, তখন আপিল বিভাগ থেকে একই রায় যদি আসত, তাহলে তাকে বৈধ বলা যেত।’
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উচ্চ আদালতেও যে দখলদারত্ব দেখা দেয়, তাতে বিচারকদের পদগুলো দখল হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা তাদের বক্তব্যও তুলে ধরতে পারছেন না। আদালতে একতরফা বক্তব্যে বিচারপতিরা যে-সব আদেশ দিচ্ছেন না নজিরবিহীন।
আপিল না করেই বিএনপি নেতা তারেক রহমান একাধিক মামলায় খালাস পেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনী ‘জয় বাংলাকে’ জাতীয় স্লোগান ঘোষণার আদেশ স্থগিত হয়েছে, দেশের সব সিটি করপোরেশন ভেঙে দেওয়ার পরেও চট্টগ্রামে এক বিএনপি নেতার দায়িত্ব পালনে সমস্যা হচ্ছে না, যদিও তিনি কয়েক লাভ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন। সরকার পতনের পর একতরফা রায়ে তিনি পদে বসে গেছেন। এর মধ্যেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরার রায় মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে সে বিষয়ে নেই কোনো সন্দেহ।