বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের জুবায়েরপন্থী ও সাদপন্থী এই দুটি অংশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান বিরোধ আবারও সহিংস সংঘাতে রূপ নিয়েছে।টঙ্গীর তুরাগ তীরে অবস্থিত বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে তাবলীগ জামাতের জুবায়েরপন্থী ও সাদপন্থী দুই পক্ষের সংঘর্ষে কমপক্ষে চারজন প্রাণ হারান।
মঙ্গলবার শেষরাতে টঙ্গীর তুরাগ তীরে তাবলীগ জামাতের জুবায়েরপন্থী ও সাদপন্থী অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণহানির পাশাপাশি প্রায় অর্ধশত মানুষ আহত হন। আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে।
সংঘর্ষের একপর্যায়ে মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারীদের ধাওয়া দিয়ে ইজতেমা ময়দানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভীর সমর্থকরা।
পরে মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারীরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ শুরু করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং সংঘাত আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা শেষে ইজতেমা ময়দান খালি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুপুরের পর সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবি সদস্যরা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘাত বন্ধ করেন এবং পরিস্থিতি স্থিতিশীল করেন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং নতুন করে সংঘর্ষের সম্ভাবনা রোধ করতে পুলিশ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ, মিছিল ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছে।
সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় উভয়পক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করছে। জুবায়েরপন্থীরা সাদপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পাশাপাশি তাদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। এই দাবি উত্থাপন করেছেন জুবায়েরপন্থীদের অন্যতম নেতা মামুনুল হক।
ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে পক্ষ দু’টির রেষারেষি, সংঘর্ষ এবং পরস্পরকে দোষারোপের ঘটনা এবারই প্রথম নয়।
২০১৮ সালে এই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিল, যা তখনও আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। এমনকি, গত নভেম্বরেও ইজতেমা ও ঢাকার কাকরাইল মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উভয়পক্ষকে মুখোমুখি অবস্থানে দেখা গিয়েছিল, যা এই দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্বের আরেকটি উদাহরণ।
পরে সরকারের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং অতীতের সমঝোতা মেনে জুবায়ের ও সাদপন্থীদের নেতারা সংঘাত এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু সেই অবস্থা থেকে পক্ষ দু’টি আবারও সংঘর্ষে জড়ালো কেন?
কীভাবে সংঘর্ষ শুরু হলো এবং এর ফলে কি সামনের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানে কোনো পরিবর্তন আসতে পারে?
সংঘর্ষের সূত্রপাত কীভাবে?
ঢাকার কাছে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে মঙ্গলবার শেষরাতে সংঘর্ষের যে ঘটনা ঘটেছে, সেটির সূত্রপাত নিয়ে জুবায়ের ও সাদপন্থীরা একে অপরকে দোষারোপ করে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা তুলে ধরেন। প্রতিটি পক্ষ নিজেদের অবস্থান সঠিক বলে দাবি করছে, এবং সংঘর্ষের জন্য অন্য পক্ষকে দায়ী করছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, আগামী শুক্রবার থেকে পাঁচদিনের জোড় ইজতেমা পালনের ঘোষণা দিয়েছেন ভারতে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ নেতা মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভীর অনুসারীরা।
কিন্তু মাওলানা সাদ কান্দালভীর অনুসারীদের পাঁচদিনের জোড় ইজতেমা পালনের ঘোষণা দেওয়ার পর, ঢাকার মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারীরা তাদের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। গত কিছুদিন ধরেই তারা সড়ক অবরোধ, প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান এবং অন্যান্য নানান কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন।
সম্প্রতি, মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারীদের অনেকেই ইজতেমা মাঠে অবস্থান নেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলে। তাদের এই পদক্ষেপ ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায়, প্রশাসনের কর্মকর্তারা উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমাধান আনার জন্য আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
এর মধ্যেই মঙ্গলবার শেষরাতে সাদপন্থীরা ইজতেমা ময়দানে ঢুকে পড়লে সংঘর্ষ শুরু হয়।
টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান জানান, “সাদপন্থীরা মঙ্গলবার রাত চারটার দিকে ইজতেমা ময়দানে ঢোকার চেষ্টা করে। সেসময় জুবায়েরপন্থীরা বাধা দিলে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যায়।”

এ ঘটনায় বুধবার বিকেল পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে প্রশাসন।
“তবে তারা কে কোন পক্ষের সেটি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি,” বলছিলেন মি. রহমান।
সংঘর্ষে দু’পক্ষের প্রায় অর্ধশত সমর্থক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর আহত বেশ কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, এবং তাদের চিকিৎসা চলছে বলে পুলিশ জানায়।
এদিকে, সংঘর্ষের খবর পেয়ে পুলিশ, র্যাব ও সেনাসদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভোরে পরিস্থিতি শান্ত করেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তাদের সুষ্ঠু কার্যক্রমের মাধ্যমে সংঘর্ষ থামানো সম্ভব হয়েছে এবং বর্তমানে পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে।
“সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং পরিস্থিতি এখন শান্ত আছে,” বলেন মি. রহমান।
উল্লেখযোগ্য যে, বিশ্ব ইজতেমার মূল পর্ব শুরু হওয়ার আগে প্রতিবছর জোড় ইজতেমার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
সে অনুযায়ী, চলতি বছর গত ২৯শে নভেম্বর থেকে ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচদিনের জোড় ইজতেমা পালন করেছিলেন কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারীরা।
এরপর ২০শে ডিসেম্বর মাওলানা সাদের অনুসারীদের একইভাবে পাঁচদিনের জোড় ইজতেমা পালন করার কথা ছিল।

কী বলছেন জুবায়েরপন্থীরা?
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে যখন জুবায়ের ও সাদপন্থীদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং তারা মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে, তখন উভয়পক্ষের নেতারা আলোচনা করতে বসেন। এই আলোচনায়, তারা অতীতের সমঝোতা মেনে চলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সংঘাত এড়িয়ে চলার প্রতিশ্রুতি দেন।
কিন্তু তারপরও মঙ্গলবার রাতে সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটলো কেন?
“তারাই (সাদপন্থীরা) এর জন্য দায়ী। এর দায় তাদেরকেই নিতে হবে,” বলে জানান তাবলীগ জামাতের জুবায়েরপন্থী অংশের অন্যতম নেতা ওমর ফারুক।
তিনি আরও বলেন, “ইজতেমা ময়দান প্রস্তুতে সারাদিন কাজ করে মুসল্লিরা রাতে ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমন্ত সেসব মুসল্লিদের ওপর তারা (সাদপন্থীরা) অতর্কিত হামলা চালিয়েছে।”
ওই ঘটনায় জুবায়েরপন্থী নেতারা দাবি করেছেন যে, তাদের সমর্থকরাই সবচেয়ে বেশি হতাহতের শিকার হয়েছেন।
“নির্মমভাবে আমাদের মুসল্লিদের হত্যা করা হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় অনেকে এখনও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন,” বলেন মি. ফারুক।
এ ঘটনার পর, জুবায়েরপন্থীরা ঘোষণা করেছেন যে, সাদপন্থীদের আর ইজতেমা করতে দেওয়া হবে না।
জুবায়েরপন্থীদের আরেক নেতা ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “তারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরেছে। সাদপন্থীরা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে, তাই তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। তারা যা করেছে তাতে তাদের আর ইজতেমার প্রশ্নই আসে না।”
একইসঙ্গে, বুধবারের মধ্যেই “হামলা ও হত্যার” ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করার দাবি করেছেন তিনি।
কিন্তু গত তেসরা ডিসেম্বর জোড় ইজতেমা শেষ করার পরও জুবায়েরপন্থীরা সেখানে কী করছিলেন?
“বিশ্ব ইজতেমা শুরু হওয়ার আগে ময়দান প্রস্তুতের অনেক কাজ থাকে। আমাদের লোকেরা সেগুলোই করছিলেন,” বলেন জুবায়েরপন্থী নেতা মি. ফারুক।

সাদপন্থীরা যা বলছেন
উল্টো অভিযোগ তুলে জুবায়েরপন্থীদের ওপর সব দোষ চাপিয়েছেন মাওলানা সাদের অনুসারীরা।
সাদপন্থীদের গণমাধ্যম সমন্বয়ক মোহাম্মদ সায়েম সাংবাদিকদের বলেন, “তারাই (জুবায়েরপন্থী) প্রথম আমাদের সাথীদের ধরে মারধর করেন।”
পূ্র্বঘোষণা অনুযায়ী, জোড় ইজতেমা পালন করতেই সাদপন্থীরা তুরাগ তীরে গিয়েছিল বলে জানান তিনি।
“২০শে ডিসেম্বর যে আমাদের জোড় ইজতেমা শুরু হবে, সেটা তো আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল। তাহলে শেষ হওয়ার পরও কেন উনারা মাঠ দখল করে রেখেছিলেন?” বলেন মি. সায়েম।
কিন্তু প্রশাসন যেখানে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন, সেখানে দু’দিন আগেই সাদপন্থীরা ইজতেমা ময়দানে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? এছাড়া রাতেই-বা কেন ময়দানে ঢুকতে গেলেন?
“রাতে মাঠে ঢোকার কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দলে দলে আমাদের সাথীরা আসছিলেন,” বলেন মি. সায়েম।

“মাঠে ঢুকতে না পেরে তারা কামারপাড়া ব্রিজ ও রাস্তার বিভিন্ন অংশে অবস্থান নেন। কিন্তু সেখানেও তাদের উপর অনবরত ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন জুবায়েরপন্থীরা। পরে আমাদের সাথীরা বাধ্য হয়ে মাঠে প্রবেশ করেন,” বলেন তিনি।
তবে সংঘর্ষের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন তারা।
“যেভাবেই ঘটুক, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক,” স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন সাদপন্থীদের নেতা রেজা আরিফ।
বুধবার দুপুরের বৈঠকে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে তারা মাঠ ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
“অতীতে আমরা সরকারের সমস্ত কথা রেখেছি, সরকারের এই কথাটুকুও আমরা রাখছি। আমরা এরই মধ্যে সেখানে উপস্থিত সাথীদের বলে দিয়েছি মাঠ ছেড়ে দিতে,” বলেন মি. আরিফ।
তিনি আরও বলেন, “সরকারি সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিয়েছি, উনারাও যেন ইসলামের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, কোনো রকম সমস্যার চেষ্টা না করেন। উনারা যেন রাস্তায় নেমে না আসেন, উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার না করেন।”

সরকার কী বলছে?
মঙ্গলবার রাতের সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনার পর, বুধবার দুপুরে তাবলীগ জামাতের বিবদমান পক্ষ দু’টির সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনায় বসেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, “এতে ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। খুনিদের কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়ার সুযোগ নাই। যারা প্রকৃত দোষী তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।”
এ লক্ষ্যে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, জুবায়েরপন্থীদের নেতা মামুনুল হক ‘সাদপন্থী’দের আর ইজতেমা করতে না দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন, সে বিষয়ে সরকারের বক্তব্য জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন সাংবাদিকরা।
সাংবাদিকদের জবাবে মি. চৌধুরী বলেন, “তারা দু’পক্ষ যদি আলোচনা করে সমাধান করতে পারে, তাহলে সাদপন্থীরা ইজতেমায় অংশ নিতে পারবেন। ইজতেমার তারিখ সরকার বাতিল করেনি। তারা আলোচনা করুক।”
উল্লেখ্য যে, এর আগে গত নভেম্বরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছিলেন, অতীতের ধারাবাহিকতায় আগামী বছরেও টঙ্গীর তুরাগ তীরে দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
এর মধ্যে, প্রথম পর্বে ৩১শে জানুয়ারি থেকে ২রা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা ইজতেমায় অংশ নেবেন ‘জুবায়েরপন্থীরা’।
এরপর, দ্বিতীয় পর্বে ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইজতেমায় অংশ নেবেন ‘সাদপন্থীরা’।
কিন্তু মঙ্গলবারের ঘটনার পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে আগামী বছর কি শান্তিপূর্ণভাবে ইজতেমা করা সম্ভব হবে?
“তাবলীগের দুই গ্রুপকেই অনমনীয় অবস্থান থেকে এসে ছাড় দিতে হবে এবং তাহলেই কেবল সুন্দর, সুশৃঙ্খল ইজতেমা উপহার দেয়া যাবে,” বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মি. চৌধুরী।

সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ
তাবলীগ জামাতের দু’পক্ষের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনার প্রেক্ষাপটে, টঙ্গীর ইজতেমা মাঠ ঘিরে তিন কিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল এবং দুই জনের বেশি জমায়েত হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে পুলিশ।
সেই সঙ্গে, ইজতেমা মাঠে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে গাজীপুর মহানগর পুলিশ।
বুধবার গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
বুধবার দুপুর দুইটা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে বলে গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, ঢাকার কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা সেক্টর-১০ এবং তুরাগ নদীর দক্ষিণ, পশ্চিম এলাকায় যে কোনো প্রকার সভা-সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে বলে বলেছেন ডিএমপি’র গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান।
“তাবলীগ জামায়াতের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘিরে যেন আর কোনও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে,” বলেন মি. রহমান।
অন্যদিকে, গাজীপুরের টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে সংঘর্ষের ঘটনায় চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, বুধবার সকাল থেকেই ওই এলাকায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
বিভক্তির শুরু হয়েছিল যেভাবে
মোহাম্মদ সাদ কান্দালভীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক তাবলীগ জামাতের নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশে দুই গ্রুপ আলাদা হয়ে দুই পর্বে ইজতেমা আয়োজন করেছেন এবং তাতে অংশ নিচ্ছেন।
এই তাবলীগ জামাতের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে, যখন ঢাকায় তাদের মূল কেন্দ্র কাকরাইলে দুই দল কর্মীর মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরের বছর কাকরাইল মসজিদের দখল নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছিলো দু’পক্ষের মধ্যে।
তাবলীগ জামাতের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে, যখন ঢাকায় তাদের মূল কেন্দ্র কাকরাইলে দুই দল কর্মীর মধ্যে হাতাহাতি হয়। এই ঘটনার ফলে তাবলীগ জামাতের মধ্যে বিভেদ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর, ২০১৮ সালে কাকরাইল মসজিদের দখল নিয়ে সংঘর্ষ হয় দু’পক্ষের মধ্যে, যা তাবলীগ জামাতের দুটি গ্রুপের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা বাড়িয়ে দেয়।
জুবায়েরপন্থী নেতা শাহরিয়ার মাহমুদ বলছেন, সাদ কান্দালভীর কিছু বিতর্কিত বক্তব্যই আলেম ওলামাদের ক্ষুব্ধ করেছে। এগুলো প্রত্যাহার করে তওবা না চাইলে তাকে এখনো বাংলাদেশে গ্রহণ করা হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“তারা এখন হেফাজতের কথা বলছে। কিন্তু পাকিস্তানে তো হেফাজত নেই। সেখানে কেন সাদ কান্দালভী যেতে পারেন না। তাকে ভুল স্বীকার করতে হবে। তওবা করতে হবে,” বলছিলেন মি. মাহমুদ।
মি. কান্দালভী তাবলীগ জামাতে কিছু সংস্কারের প্রয়োজনের কথা বলে আসছিলেন আগে থেকেই। এ নিয়ে ২০১৭ সালেই ভারতে তাবলীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিভক্তির সূত্রপাত হয়।
তার একটি বক্তব্য ছিল যে “ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়”। অনেকেই মনে করেন যে এই বক্তব্যের মাধ্যমে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিনিময়ে অর্থ নেয়ার বিপক্ষে বলা হয়েছে।
সাদ কান্দালভী ওই সময়ে আরও বলেছিলেন, “মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত, যাতে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ে।”
এসব বক্তব্য দারুল উলুম দেওবন্দ অনুসারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে এবং তাদের বক্তব্য কান্দালভীর কথাবার্তা আহলে সুন্নাত ওয়া’ল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে।

সাদ বিরোধীরা বলছেন যে, তাদের বিরোধিতার মূল কারণ হলো সাদ কান্দালভী নবীকে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিতর্কিত বক্তব্য রেখেছেন।
এদিকে, সাদ অনুসারী অংশের নেতা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম বলছেন সাদ কান্দালভি কোনো বিতর্কিত মন্তব্য করেননি। তিনি যৌক্তিক কথা বলেছেন এবং ধর্ম নিয়ে যেন ব্যবসা না হয় সেটি বলেছেন।
“তৃতীয় পক্ষ এখানে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তাবলীগ জামাত নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তারা। আমাদের বাধা দিলে আমরা সরকারের সাহায্য চাইবো। সহিংসতা আমরা চাই না। কিন্তু আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। অসংখ্য অনুসারী আমাদের। তাদের আটকে রাখা যাবে না,” বলছিলেন মি. ইসলাম।