
কায়িক পরীক্ষা ছাড়া পাকিস্তান থেকে পণ্য আসছে। দেশটি সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। এর মধ্যে ২০ বছর পর দুই দেশের যৌথ যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলা নিউয নেটওয়ার্ক বিশেষ প্রতিবেদন
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে ‘অতি মাখামাখি’র চেষ্টার মধ্যে এবার দুই দেশের অকার্যকর হয়ে যাওয়া দুই দেশের যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দেশটির সংবাদ মাধ্যম এও খবর দিয়েছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তান সফরে যাওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে পণ্যের নামে প্রশ্নবিদ্ধ চালান আসছেই।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে থাকার সময় সবশেষ ২০০৫ সালের ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর এই কমিশনের অষ্টম ও শেষ বৈঠক হয়েছিল ঢাকায়। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৬ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে নবম সভা হওয়ার কথা ছিল।
তবে ওই বছর অষ্টম সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশে আন্দোলন, ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি এবং ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ১৫ বছরে এই কমিশন আর কার্যকর হয়নি।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর যে আগ্রহ দেখাচ্ছে, সেখানে ২০ বছর পর ফের কমিশনের বসার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক আদেশে ফেব্রুয়ারির শেষে বৈঠক আয়োজনের কথা বলা হয়েছে।
সভাটি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা রয়েছে বলে পত্রে জানানো হয়।
সেই বৈঠককে সামনে রেখে আগামী ২১ জানুয়ারি মধ্যে তথ্য/মতামত পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
মোট ১৫ জনের কাছে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের নির্বাহীরা হলেন, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, কৃষি সচিব, বস্ত্র ও পাট সচিব, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব।
বাকিদের মধ্যে আছেন আর্মড ফোর্স ডিভিশনের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, যেটি ইঙ্গিত দেয় যে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক বিষয়েও সহযোগিতা বাড়াতে চায় ইউনূস সরকার।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যানের কাছেও মতামত চাওয়া হয়েছে।
সবশেষ এই কমিশনের বৈঠক যখন হয়েছিল, তখন অর্থনীতির নানা দিকে পাকিস্তান স্পষ্টতই বাংলাদেশ থেকে এগিয়েছিল। তবে গত দেড় দশকে দেশটিকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ যে কারণে সেখানকার রাজনীতিক ও লেখকরা বাংলাদেশ হওয়ার বাসনার কথা বলছে।
পাকিস্তান নিয়ে অতি উৎসাহ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে পাকিস্তানে উল্লাস হয়েছে। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকেও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে আর এরপর থেকে ঢাকায় দেশটির হাইকমিশনার সৈয়দ আহমদ মারুফের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। তিনি সরকারের উপদেষ্টাদের কাছে ছুটে যাচ্ছেন তারা তদবির নিয়ে, তেমনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গেও তার উঠাবসা দেখা যাচ্ছে নিয়মিত। বাংলাদেশে কোনো দেশের দূতের এত মাখামাখি এর আগে কখনও দেখা যায়নি।

২ সেপ্টেম্বর সৈয়দ আহমদ মারুফ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সাক্ষাৎ করেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সঙ্গে।
উপদেষ্টাকে পাকিস্তানি হাইকমিশনার বলেন, ‘আমরা ১৯৭১ এর প্রশ্নটিকে সমাধান করতে চাই। কিন্তু গত সরকার আমাদেরকে আলোচনার কোনো সুযোগ দেয়নি এবং ইচ্ছে করেই ৭১ ইস্যুটাকে জিইয়ে রাখত। চাইলে বহু আগেই এটির সমাধান করা যেত। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আদর্শে ১৯৭১ ছিল ইতিহাসের শেষ অধ্যায়। কিন্তু আমরা মনে করি এটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা।…আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ৭১ এর প্রশ্নটির সমাধান করতে চাই।’
পাঁচ মাসের ব্যবধানে মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেছে দু্ই দফা। গত ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে নিউ ইয়র্কে এক দফা এবং ১৯ ডিসেম্বর ডি-৮ সম্মেলনের ফাঁকে মিশরের রাজধানী কায়রোতে একটি হোটেলে ফের বৈঠক করেন দ্বিতীয় দফায়।
এই বৈঠকে শাহবাজ শরিফকে ১৯৭১ সালের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো মীমাংসা করার আহ্বান জানান ইউনূস। তবে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট তা পাত্তা না দিয়ে দাবি করেন, ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত বিষয়গুলো মীমাংসা করেছে, কিন্তু যদি অন্যান্য অমীমাংসিত সমস্যা থাকে, তবে সেগুলো দেখতে পেলে তিনি খুশি হবেন।
পাকিস্তান থেকে আসলে আসছে কী?
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চালু নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যের যে হাল, তাতে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল হতে পারে কি না, তা নিয়ে প্রশ্নের মধ্যেই এসেছে দুটি জাহাজ। মুক্তিযুদ্ধের পর এই প্রথম করাচি থেকে এসেছে জাহাজ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসেব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ৭৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি ছিল ৮০ কোটি ডলারের মত।
দেশটি থেকে বাংলাদেশে মূলত পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, চামড়া, ক্লিংকার, ফেব্রিক্স, তুলা, পেঁয়াজ ও আলু আসে। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয় চা, তৈরি পোশাক, কাঁচা পাট প্রভৃতি, সব মিলিয়ে এই রপ্তানি মূল্য ৬ কোটি ডলারের কিছু বেশি।

এর মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশে গত ১১ নভেম্বর প্রথমবারের মতো এবং ২১ ডিসেম্বর আসে দ্বিতীয় জাহাজ। তার আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের এক আদেশের পর সেই জাহাজে কী আসছে, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাকিস্তান থেকে পণ্য এলেও চট্টগ্রাম বন্দরে সেসবের শতভাগ কায়িক পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা ছিল।জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ২৯ সেপ্টেম্বর এক আদেশে এই পরীক্ষার শর্ত তুলে দেয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে আসা সব পণ্য লাল তালিকাভুক্ত করেছিল এনবিআর।
কায়িক পরীক্ষা না হওয়ায় জাহাজে করে আসলে কী এসেছে, সেই প্রশ্নের সমাধানে নথিপত্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
এর মধ্যে দ্বিতীয় জাহাজে করে ‘ভয়ংকর বিস্ফোরক’ দ্রব্য আনা হয়েছে কি না, সেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
পণ্য খালাসের সময় উপস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তা বিডি ডাইজেস্ট-এর কাছে সেদিনের বিস্ফোরক দ্রব্যবাহী কনটেইনার দুইটির ছবি ও তথ্য দিয়েছেন।
পরিদর্শনের পর কনটেইনার দুইটি নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা এক ঘণ্টার জন্য আটকে রাখেন। কিন্তু পরে অজ্ঞাত কারণে কনটেইনার দুইটি ছেড়ে দেওয়া হয়।
সেদিনের বেশ কিছু ছবি পাওয়া গেছে যাতে জাহাজে করে আসা একটি কনটেইনারে ‘এক্সপ্লোসিভ (বিস্ফোরক)’ লেখা বহু প্যাকেট দেখা গেছে।
সেদিন বন্দরের কর্মীরা পণ্য ডেলিভারি স্থগিতের নির্দেশ দিলেও এক ঘণ্টার মধ্যেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পণ্য খালাসের আদেশ দেওয়া হয়।
কার্টনের গায়ে মুদ্রিত তথ্য অনুযায়ী, পণ্যটি কম্বোডিয়ান একটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত। তবে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে খুব সামান্যই তথ্য পাওয়া গেছে। আর কন্টেইনারগুলো পাকিস্তান থেকে আরব আমিরাত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে।
পাকিস্তান যাচ্ছেন ইউনূস?
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন গত ৩ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মুহাম্মদ ইউনূস ইসলামাবাদ সফরের জন্য পাকিস্তানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। তরে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এখনও এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আগামী মাসে দার বাংলাদেশ সফর করবেন। ২০১২ সালের পর দেশটির কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর হতে চলেছে।