সৈয়দ ইফতেখার হোসেন, লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
লেখার শিরোনামটি প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগরের একটি ইউটিউব থেকে নেওয়া। এই জুতার মালা অন্য কোনো সময় নয়, পরানো হয়েছে শান্তির ফেরিওয়ালা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা জবর দখলকারি ড. ইউনুসের দুঃশাসনকালে। ধর্মে আছে সৃষ্টিকর্তা একজন মানুষকে কোনো একটি দায়িত্বে বসিয়ে তার সততা, ন্যায়পরায়নতা, শাসনকাজে নিরপেক্ষতা পরীক্ষা করেন। একাদশ শতকের আরব দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ইমাম গাজ্জালী শাসনকর্তাদের জন্য তার প্রণীত ‘নসিহত-ই-মুলক’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ‘ও শাসনকর্তা তোমার পূর্বে যাহারা আসিয়াছিলেন তাহারা চলিয়া গিয়াছেন, তোমার পরে যাহারা আসিবেন তাহারা পূর্ব নির্ধারিত, তুমি তোমার শাসনকালে এমন কাজ করিবে যাতে তুমি চলিয়া যাওয়ার পর মানুষ তোমাকে তোমার ভাল কাজের জন্য মনে রাখে’।
যেভাবেই হোক ইউনূস গত ৮ আগস্ট নির্বাচিত একটি সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যূত করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছেন। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার এই ষড়যন্ত্র তিনি সবার অলক্ষ্যে শুরু করেছিলেন ২০১৯ সালের পর। এক ক্ষমতাধর শেখ হাসিনা সরকার তা বুঝতে ব্যার্থ হয়েছিল । ড. ইউনুস সর্বাত্মক সহায়তা পেয়েছিলেন বিদেশি একাধিক সরকারের, যার মধ্যে ডেমোক্র্যাট দলীয় শাসনে থাকা মার্কিন প্রশাসনের। তারা এই দেশে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের মাধ্যমে কয়েক শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে। যাদের হাত দিয়ে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে বর্তমানে তাঁদের প্রায় সবাই ইউনূসের উপদেষ্টা অথবা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এই সব কাজে আড়ালে থেকে ইউনূসকে সার্বিক সহায়তা করেছে কিছু জঙ্গি সংগঠন যার মধ্যে বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরির অন্যতম।
হিযবুতের প্রধান সারির নেতা মাহফুজ আলম (আসল নাম মাহফুজ আবদুল্লাহ) বর্তমানে ইউনূসের দপ্তর বিহীন উপদেষ্টা। ইউনুস অ্যামেরিকায় গিয়ে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে সবার সামনে প্রথমবারের মতো তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ঘোষণা করেন ‘এই সেই ব্যক্তি যে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার রদবদল সুচারুভাবে (মেটিকুলাসলি) পরিকল্পনা করেছিলেন। ইউনুসের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরো ছিল একাত্তরের ঘাতক দল জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবির। ২০১৩ সালে অ্যামেরিকার নিরাপত্তা বিষয়ক সাময়িকী জেনস গ্লোবাল টেরোরিজম এন্ড ইনসারজেন্সি অ্যাট্যাক সূচকে ছাত্র শিবিরকে বিশ্বে তৃতীয় ভয়ংকর সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
ইউনূস ক্ষমতা দখল করার পর যে কটি বিষয়ের উপর নজর দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল এই দেশের ইতিহাসে যে একাত্তরে একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং তার নেতৃত্ব দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দল আওয়ামী লীগ তা ভুলিয়ে দেওয়া। ইউনূস ক্ষমতা দখল করার পরপরই একাত্তরের সব স্মারক ধ্বংস করেছেন। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগন নিষিদ্ধ করেছেন । বাঙালির মুক্তিযুদ্ধেও গৌরবের সময়টাকে ভুলিয়ে দেয়ার জন্য যা যা করার দরকার তার সব কিছুই তিনি করেছেন। শুরুতে কারো গায়ে আওয়ামী লীগ বা তার কোনো অঙ্গসংগঠনের দূরবর্তী সম্পর্কও যদি থাকে তাকে হয় কারাগারে যেতে হয়েছে অথবা তার সমর্থক গোষ্ঠীর হাতে পরে চরম লাঞ্ছিত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তাকে এই ব্যাপারে সহায়তা করেছে জামায়াত শিবির ও হিযবুত সদস্যরা। এদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য ছিল। এরা নানা অপকৌশলে দলে ঢুকেছিল।
সর্বশেষ ভয়ংকর অপকর্মটি ইউনুসের দুর্বৃত্ত বাহিনী করেছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। প্রায় ৯০ বছর বয়সী স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হাই কানু। যৌবনে দেশমাতৃকার টানে নিজের জীবন বাজি রেখে একাত্তরে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে অর্জন করেছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ভূষিত হয়েছিলেন ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে। তাঁর চাওয়া-পাওয়ার কিছু ছিল না। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে গিয়েছিলেন স্বাভাবিক জীবনে। সম্পৃক্ত ছিলেন কৃষক লীগের কর্মকাণ্ডে। ইউনূস সরকারের দৃষ্টিতে কানুর দুটি অপরাধ। প্রথমটি তিনি তার প্রিয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে যে দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তার সঙ্গে কানুর এখনো সম্পৃক্ততা আছে। তাঁকে শায়েস্তা করতেই হয়। এগিয়ে এলো তাঁর লালিত দুর্বৃত্ত বাহিনী জামায়াত শিবির।
তারা গত সোমবার আবদুল হাই কানুকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে স্থানীয় বাজারে প্রকাশ্যে প্রদক্ষিণ করায়। ভাবটা এমন, দেশকে পাকিস্তান থেকে পৃথক করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার শাস্তি কি হতে পারে এটি একটি ছোট নজির। এরপর ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে জোড়া লাগাতে গেলে কেউ যেন টু শব্দটি না করে। যে পাকিস্তান একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয়েছিল ‘আমরা তো তাদেরই বংশধর। আমাদের জন্মদাতাদের তো তারাই ধর্ষণ করেছিল’। এই পাকিস্তানিরা যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল ‘আমরা চলে যাচ্ছি তবে আমাদের বীজ রেখে যাচ্ছি। আগামীতে তারাই কথা বলবে’। সেই পরাজিত পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া বীজ এখন কথা বলছে। কানুর ঘটনাটি দেশের কোনো মিডিয়াতে তেমন স্থান পায়নি। পেয়েছে জামায়াতের দুটি দৈনিক, ‘সংগ্রাম’ ও ‘নয়া দিগন্তে’। তারা তাদের ক্ষমতা দেখাতে চেয়েছে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করুন না কেন, তিনি একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জীবন্ত প্রতীক। কানুর গলায় জুতার মালা পরানোর অর্থ হচ্ছে এই দূর্বৃত্তরা একজন কানু নয়, জুতার মালা পরিয়েছে ৩০ লাখ শহীদ ও বাংলাদেশের গলায়। এর আগে এরা ইউনূসের ইশারায় বাংলাদেশের জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর বাড়িতে আগুন দিয়ে তা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করেছে। বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য ভাঙার আগে তাতে জুতার মালা পরিয়ে প্রকাশ্যে তার মাথার উপর প্রস্রাব করেছে। আর এই সব দূর্বৃত্তদের যত অপকর্ম তাদের নেতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অ্যামেরিকার জাতীয় মিডিয়া ভয়েস অব অ্যামেরিকায় সঞ্চালককে বলেন ‘ও সব কিছু না। ওরা রিসেট বাটন টিপেছে। ইতিহাসকে হালনাগাদ করেছে মাত্র ’।
আবদুল হাই কানুর ঘটনা দেশে ও বিদেশে তুমুল হৈচৈ ফেলেছে। অনেকটা বাধ্য হয়ে ইউনূস ঘটনার মৃদু নিন্দা করেছেন। বলেছেন, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। একই সঙ্গে তিনি জুড়ে দিয়েছেন যে কানুর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ছিল। তাহলে তিনি কি এটি জায়েজ করে দিলেন যে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা থাকলে তাকে যে কেউ যে কোনো জায়গায় এমন অপমান বা হেনস্তা করতে পারবে ? কানুর অপমানের প্রতিবাদে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ করেছেন। এদের মধ্যে বিএনপি সমর্থকরাও ছিল। এর জন্য তাদের সাধুবাদ দিতে হয়। তবে কেন্দ্রিয়ভাবে বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বিএনপিতেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন। প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া ফরমেশন কমান্ডার ছিলেন। জেনারেল মীর শওকত আলী, কর্ণেল অলি, মেজর হাফিজ, কর্ণেল শমশের মুবিন চৌধুরী (বর্তমানে অজ্ঞাত কারণে কারাগারে), সাদেক হোসেন খোকাসহ আরো অনেকেই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা তো তাঁদের একজন পূর্বের সহযাত্রীকে এমনভাবে অপমানিত হতে দেখে উৎফুল্ল হতে পারেন না।
ড. ইউনূসের মনে রাখা উচিৎ গত সোমবার অ্যামেরিকার দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান জ্যাক সুলেভান মিষ্টি মিষ্টি কূটনৈতিক ভাষায় বাংলাদেশে চলমান মানবাধিকার সম্পর্কে কী নসিহত করেছেন। সুলেভানরা আগামী ২০ জানুয়ারি থেকে আর ক্ষমতায় থাকছেন না। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসছেন রিপাবলিকান দলীয় ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইউনূস এর আগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হিলারি ক্লিনটনকে জেতাতে কয়েক মিলিয়ন ডলার তাঁর নির্বাচনী তহবিলে জমা করেছিলেন। এই ঘটনা ট্রাম্প ভুলেননি। বরং তিনি নানাভাবে তা ইউনূসকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ঘটনা চক্রে আগামীতে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে ড. ইউনুস ও তাঁর সভা পারিষদদের কি হবে তা শুধু আল্লাহই জানেন। এখন যা হচ্ছে তা হয়তো বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে। সময় থাকতে সাবধান হওয়া সবার জন্য মঙ্গল। দার্শনিক গাজ্জালির কথামতে, ড. ইউনূসকে ইতিহাস একটি সম্ভাবনাময় দেশ ধ্বংস করার জন্য মনে রাখাবে। মনে রাখবে দেশের রাজনীতিতে একজন বড় খলনায়ক হিসেবে ।