ব্যাংকে টাকা আসছে কম, ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি ৪১ মাসের বছরের সর্বনিম্ন। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গত ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। পরিকল্পনা উপদেষ্টাই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন অর্থনৈতিক মন্দা আসছে।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
চারটি মাস পেরিয়ে গেল, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতির কোনো একটি ক্ষেত্রে নূন্যতম সাফল্য দেখাতে পেরেছেন, এমন উদাহরণ নেই। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থমকে আছে, বাজারে অর্থ সংকট, ব্যাংকে টাকা আসছে না, বিনিয়োগের জন্য ঋণ নিচ্ছে না উদ্যোক্তারা, কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা, বাইরের মানুষ না, স্বয়ং সরকারের তরফেই বলা হয়েছে মন্দা আসছে।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের আয় কমে গেছে, সে কথা কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, এমনকি বাদাম বিক্রেতার বিক্রি কমে গেছে, ফুটপাতে চায়ের দোকানেও আগের মত বিক্রি হচ্ছে না, মাংসের ভোগ তিন মাসে যে অর্ধেকে নেমেছে, সেটি সরকারের প্রতিবেদনেই ফুটে উঠেছে।
মানুষের আয় কমে যাওয়ার মধ্যে আবার খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে ১৪ শতাংশে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ নতুন জ্ঞান দিয়ে বলেছেন, একটি জিনিসের দাম বাড়বে, একটি কমবে, এটিই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন নামাই বলে দিচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি নামতে নামতে ঠেকেছে ৭ শতাংশে। ব্যবসা বাণিজ্য, আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম, কোনো কিছুতেই গতি নেই। এর কোপটা পড়তে যাচ্ছে দেশের উন্নয়ন ব্যয়ে।
চার মাসে উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে কেবল ৭ শতাংশ, যা ত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর মানে হচ্ছে অর্থ ছাড়ে কিছুটা অগ্রগতি হলেও মাঠ পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থমকে আছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস দুশ্চিন্তার আরেক নাম। গত অক্টোবরে সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আউটলুক নামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ২ শতাংশে নেমে যেতে পারে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে পরিকল্পনা সাজায়। সামনের প্রতিবেদনে তা আরও কত নামে সেটিই দেখার বিষয়।

অথচ ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা এক যুগ বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়েছে তরতর করে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের শুরু থেকে অনেকটা চাপ তৈরি হয়। গত দুই বছরে মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ক্ষয়, টাকার দরপতন দেখেছে দেশ। তবু এমন করুণ অবস্থায় পড়তে হয়নি মানুষকে। স্থবির সরকারের অর্থ উপদেষ্টা দাবি করছেন তারা অনেক কাজ করছেন। প্রমাণ হিসেবে বলেছেন, ঘন ঘন বৈঠক করছেন তারা।
অর্থ সংকটে সরকার, উন্নয়নে ব্যাঘাত
অর্থনীতির করুণ চিত্র ফুটে উঠে রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যানে। ব্যবসা বাণিজ্যের স্থবিরতায় কমছে সরকারের রাজস্ব আয়ও। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রাজস্ব আদায় হয়েছে এক লাখ এক হাজার ২৮১ কোটি টাকা, এটি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এটি ৩০ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা কম।
গত বছর আওয়ামী লীগ শাসনামলে এই প্রান্তিক কেবল না, গোটা অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। নির্বাচনের বছর না হলে হয়ত আরও বাড়ত। এটি ছিল গতিশীল অর্থনীতির প্রমাণ।
কিন্তু এবার অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে ১ দশমিক ০৩ শতাংশ। রাজস্ব কম আসছে বলে কোপটা গিয়ে পড়বে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। এরই মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সামনে নিশ্চিতভাবেই আরও কমবে, আর কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রকল্প না করার কথা। অর্থবছরে এডিপির আওতায় ১ হাজার ৩২৬টি প্রকল্প আছে। এর মধ্যে অনেক ২০২৩ সালে অন্তর্ভুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যয় দেখা যায়নি।

কেবল দেশীয় রাজস্ব না, বিদেশিরা কাড়ি কাড়ি ডলার নিয়ে বসে আছে দাবি করলে বাস্তবতা হচ্ছে অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৯৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসের ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি মিললেও এবার মিলেছে ২৫ কোটি ৪৫ ডলার।
বিদেশি ঋণ ও অনুদানের অর্থছাড়ও কমেছে। চলতি অর্থ বছরের প্রথম চার মাসে ছাড় হয়েছিল ১২০ কোটি ২০ লাখ ডলার, আগের বছর যা পরিমাণ ছিল ১৬২ কোটি ৬১ লাখ ডলার, এবার কমেছে ২৬ দশমিক ০৮ শতাংশ।
কেবল ঋণ নয়, সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সাতটি কোম্পানি দরপত্রের নথি কিনলেও নির্ধারিত সময়ে কেউ তা জমা দেয়নি। অর্থাৎ বিদেশিরা এই সরকারের সময়ে অনিশ্চয়তার কারণে আগ্রহী হচ্ছে না।
ব্যাংকে আমানত-ঋণ বিতরণের করুণ চিত্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি গত জুলাই থেকে টানা চার মাস কমেছে। অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি নেমেছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
করোনাভাইরাস মহামারিতে লকডাউন পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের মে মাসে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পর কখনও তা ৯ শতাংশের নিচে নামেনি।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে নতুন বিনিয়োগ করার সুযোগ নেই। বর্তমানে ব্যবসার যা অবস্থা তাতে বেঁচে থাকার সংগ্রামটাই করতে হচ্ছে পোশাক খাতের মালিকদের।’ দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত থমকে দাঁড়ালে ডলার কোত্থেকে আসবে, কর্মসংস্থানের কী হবে, ৬০ লাখ শ্রমিকের ভবিষ্যৎ কী- এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়ীদের হয়রানির প্রাণান্ত চেষ্টার মধ্যে বেতন না পেয়ে শ্রমিকদের বিক্ষোভ থামছেই না। বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ৫ শতাংশের জায়গায় ৯ শতাংশ করার পরে বিক্ষোভ আরও বেড়েছে। প্রতিদিন বন্ধ হচ্ছে কারখানা।
অন্যদিকে সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর বিরাট কারখানা লুট করে আগুন ধরিয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয়েছে, চাকরি হারিয়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক, গাজীর পণ্যের ব্যবসা করে, পণ্য পরিবহন করে যারা পেট চালাতেন হাতের আয়ের পথ বন্ধ।
চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপ, ঢাকার বসুন্ধরা গ্রুপকে চাপে ফেলতে গিয়ে, তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি করতে গিয়ে একইভাবে হাজার হাজার কর্মীর জীবনকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। চাকরি হারা মানুষগুলো কোথায় কাজ পাবে, নেই সেই প্রশ্নের জবাব।

ব্যাংক যে ঋণ বিতরণ করবে, সেই সক্ষমতাও কমছে। ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি টানা দুই মাস হয়েছে সাত শতাংশের কিছু বেশি। অথচ আওয়ামী লীগ শাসনামলে করোনা ভাইরাস মহামারীর সময় সুদহার ৪ শতাংশ বা তার চেয়ে নিচে নামার পরেও তা ছিল ১১ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকেরই একজন অতিরিক্ত পরিচালক বলেছেন, ব্যাংকখাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হওয়া উচিত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। সেই হিসাবে এটি কাঙিক্ষত হারের অর্ধেকের মত।
গত জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, সে সময় আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, অর্থনীতির যে আকার, তাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হওয়া উচিত ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ। তিনি গভর্নর হওয়ার পর চার মাসের ধাক্কাতেই সেটি নেমেছে অর্ধেকেরও নিচে। সিটিজেনস ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ মাসুম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকে আমানত কমছে।
তার মতে, ‘সংসারের খরচ আগের চেয়ে বাড়ছে। সেই অনুযায়ী আয় নেই। তাই মাস শেষে হাতে টাকা না থাকার কারণে ব্যাংকে আমানত কমছে।’
মন্দার আসছে, বলেছেন খোদ উপদেষ্টা
উপদেষ্টাদের মধ্যে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মাঝেমধ্যে ‘সত্য’ কথাটা বলে বসেন। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেকের সবশেষ সভা শেষে ব্রিফিংয়ে তিনি নিজেই মন্দা আসছে বলে পূর্বাভাস দেন।

সরকারে থেকেও তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে, বিশৃঙ্খলার কারণে বেসরকারি খাতে উৎপাদন যা আছে সেখানে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। গার্মেন্ট খাতে স্থবিরতা আছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নাইই। তার ওপর সুদের হার অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না, অন্য দিকে সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ও যদি না বাড়ে তাহলে তো অর্থনীতির মন্দা অবস্থা তৈরি হবে।’
এর মধ্যে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ব্যবসায়ীদের আর সুরক্ষা না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাতকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আপনারা অনেকেই বুঝতে পারেন যে, যেসব শিশু এখনও শিশুই রয়ে গেছে। শারীরিক দিক থেকে বড় হয়ে গেছে, কিন্তু তারা নিজেদেরকে বলে এখনও প্রোটেকশন দিতে। এই প্রোটেকশনের দিন কিন্তু চলে গেছে।’
মাংস বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে
মানুষ যেখানে চারটা ডাল ভাত থেকেই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে মাছ-মাংস বিলাসিতা হয়ে যাচ্ছে। সরকারের পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দিচ্ছে এর। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মাস জুলাইয়ে আন্দোলন, সংঘাত সহিংসতার মধ্যেও দেশে ১২ লাখ ২৫ হাজার টন মাংস ভোগ করে মানুষ। আগস্টে সেটি ৬ লাখ ৪১ হাজার টন, সেপ্টেম্বরে ৬ লাখ ৩৯ হাজার টন, অক্টোবরে নেমেছে ছয় লাখ টনে।