সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরের মংলারগাঁও গ্রামের এই ঘটনাটি চাপা পড়ে গেছে এই কারণে যে, দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো এ বিষয়ে প্রতিবেদনই প্রকাশ করছে না।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
বাংলাদেশে সুনামগঞ্জে হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রামে ‘তৌহিদী জনতার’ হামলার সময় এক প্রবীণকে ইসলাম ধর্মের কালেমা পড়তে বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এসব বিষয়ে পুলিশ মুখ খুলছে না।
একটি ফেসবুক পোস্টের কমেন্টে নবী মোহাম্মদকে অবমাননার অভিযোগ তুলে গত ৩ ডিসেম্বর রাতে সিলেটের অদূরে এই জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরের মংলারগাঁও গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া হামলা করা হয় মিছিল নিয়ে। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েও ঠেকানোর চেষ্টা করেনি।
সরকার পতনের পর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অব্যাহত হামলার মধ্যে দেশ-বিদেশের চাপের মধ্যেই হামলাকারীরা মিছিল নিয়ে গিয়ে সেই গ্রামের ৩৫ থেকে ৪০টি হিন্দু বাড়ি ও ১০ থেকে ১৫টি দোকান ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাট করে, মারধর করা হয় অনেককে, ভাঙচুর করা হয় মন্দিরও।
কয়েক ঘণ্টা ধরে তাণ্ডবে গোটা গ্রামটি লন্ডভন্ড করলেও দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো এই ঘটনায় বিস্ময়করভাবে নীরব। তবে বিবিসি বাংলা, ডয়েচে ভেলের মত আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এই ঘটনাটি এলেও এখনও চাপা পড়া অনেক কিছু রয়ে গেছে।
৭৫ বছর বয়সী অবনি দাসের ঘটনাটিই উল্লেখযোগ্য। হামলাকারীরা সেই রাতে তার বাড়িঘরও ভাঙচুর করে, সেই সঙ্গে তাকে কালেমা পড়তে বাধ্য করা হয়, যেটি ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। কালেমা পড়িয়ে মুসলমান করা হয়।
সেদিনের ঘটনা তুলে ধরে অবনি দাশ বলেন, ‘আমি রাত সাড়ে ৭টার দিকে ভাত খেয়ে শুয়ে থাকি। হঠাৎ চিৎকার শুনি উঠে জানতে চাই কী হইছে। এর ১০ মিনিট বাদে (পড়ে) অনেক মানুষ এসে বাড়িঘরে হামলা করে।’
বাড়িতে রাখা কোদাল দিয়েই সেই রাতে ঘরবাড়িতে আঘাত করা হয়। বাড়িতে বিদ্যুতের মিটারটি তারা ভেঙে ফেলে।
তখন অবনি বলেন, ‘আর কোদাল দিয়ে বাড়ি দিও না, তদের আল্লাহর দোহাই।‘
তিনি বলেন, “এ সময় আমাকে বলে, ‘কলেমা পড়’, আমি বলি, ‘বল, আমি কলেমা পড়মু (পড়ব)’। আমারে কলেমা পড়ায়, পরে বলি চলে যা আমি তো পড়েছি।”
এর কিছু সময় পর ঘর থেকে বের হয়ে অবনি দেখেন বাড়িঘরে ভাঙচুর করে শেষ করে ফেলেছে।
অবনি দাসের স্ত্রী মালতি রানী বলেন, ‘‘ঘটনাটি মনে হলে শরীর কাঁপে, রাতে ঘুমাতে পারি না। দুই দিন বাড়ির বাহিরে ছিলাম।’
হামলাকারীরা ছিল বেপরোয়া
হামলার সময় বেদম পেটানো হয় ৫৫ বছর বয়সী সুবোধ দাসকে। তিনি এখনও বাড়িতে ফেরেননি, রয়েছেন সিলেট শহরের মেজরটিলা এলাকায় এক স্বজনের বাসায়। এখানে থেকেই চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা কার্যক্রম।
মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘তারা আমার হাতে, কোমরে ও উরুতে রুইল (কাঠের শক্ত লাটি) দিয়ে বাড়ি দিয়েছে। আমার শরীরে পাঁচটি বাড়ি মেরেছিল, আমাকে মেরে ফেলত তারা।’
হামলার পর ধেকে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ডাক্তার বলেছেন লাঠির আঘাতের কারণে আমার রগ জায়গা থেকে সরে গেছে। বর্তমানে আমি বসতে পারি না, বাথরুম করতে পারি না ও ঠিকমতো হাঁটতে পারি না।’
মেডিসিন ও হাড় বিশেষজ্ঞ তার চিকিৎসা করছেন, বলেছেন, সুস্থ হতে সময় লাগবে।
আরেক ভুক্তভোগী শিল্পী রানী দাস বলেন, ‘এমনভাবে হামলা করা হয়েছিল নিজেদের রক্ষা করার মত না। হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিল। তখন অনেকে হাওরে-জঙ্গলে ছিল। আমি আমার আট বছরের ছেলে কে নিয়ে চৌকির (খাট) নিচে ছিলাম।’
পরেরদিন সকালেও আবার হামলার কথা ছড়িয়ে পড়ে। তখন সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে যান। এক সপ্তাহ পরে গ্রামে ফেরেন।
শিল্পী ফিরলেও তার পাশের ৪ থেকে ৫টি ঘরে এখনও কেউ আসেনি বলে জানাচ্ছেন। বলেন, ‘সন্ধ্যা হলেই আমার স্বামীকে বাড়িতে চলে আসতে বলি। এখনও মনে ভয় কাজ করে।’
ভয় কাটে না
মতি সূত্রধর হামলার পাঁচ দিন পর সবাইকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলেও এখনও আতঙ্ক রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘ভাঙচুর করা ঘরবাড়ি ফেলে রেখেই চলে গিয়েছিলাম। বর্তমানেও ভেতরে কিছু-কিছু ভয় আছে।’
ব্রীরেন্দ্র দাস নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘গ্রামের সব মানুষ এখনও আসেনি। আমাদের মাঝে আতঙ্ক এখন কাটেনি।’
হামলার পর গ্রামে অবশ্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে হামলার পরে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া সব পরিবার এখনও ফেরেনি, লুটপাট করা দোকানগুলো এখনও চালু করা যায়নি।
ব্রীরেন্দ্র দাসের প্রতিবেশী কল্পনা রানী দাস বলেন, ‘হামলার সময় আমরা ঘরের ভেতরে ছিলাম। মারপিট করা হয়েছিল। তারপর আমরা বাড়ি থেকে চলে যাই, চার দিন পর এসেছি।’
তার স্বামী ৭২ বছর বয়সী সুবোধ রঞ্জন দাস অসুস্থ। তার কপালেও লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল।
কল্পনা বলেন, ‘আমার হাতেও আঘাত লেগেছিল। আমাদের ভয় কাটে না, কানের শব্দও যায় না।’
বাধন দাস নামে এক যুবক বলেন, ‘আমাদের ভেতরে ভয় থাকে, কখন কী হয় বোঝা যাবে না। আমাদের ছোট বাচ্চাদের ভেতরে ভয় কাজ করছে।’
বেপরোয়া লুটপাট
হামলার সময় রনি দাস নামে এক যুবকের দোকান লুট করা হয়েছে। নিজের সব সঞ্চয় জমিয়ে দোকানটি দিয়েছিলেন তিনি। এখন কীভাবে জীবন চলবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছেন।
রনি বলেন, ‘রাস্তার পাশে থাকা আমার দোকানে আগুন দিয়ে সবকিছু শেষ করে দেওয়া হয়েছে। দোকানে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মাল ছিল। আমার মোবাইল ও বেচাকেনার টাকা ছিল, কিছুই পাইনি।’
কেবল দোকানে নয়, ভাঙচুর ও লুট করা হয়েছে তার ঘরেও।
তিনি বলেন ‘আমাদের পরিবার দোকানের ইনকামের ওপর নির্ভর ছিল, এটা সবাই জানে। এখন একেবারে নিঃস্ব। আমার গরুর ঘরটিও ভাঙছে, দুটি গরু বাইরে রাখছি।’
লুটপাটের শিকার বেশিরভাগ গ্রামবাসীই জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছেন, কিন্তু তাদের সহায়তায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
আসামি ছাত্রলীগের নেতাকর্মী-হিন্দু যুবক
এই সাম্প্রদায়িক আক্রমণের পর সংবাদ সংগ্রহে বাধা দেওয়া হলেও ঘটনার ১০ দিন পর ১২ জনের নাম উল্লেখ করে যে মামলা করেছে পুলিশ।
উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হাসান হৃদয় বলেন, ‘মামলায় যে ১২ জনের নাম রয়েছে এর মধ্যে ১১ জনই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। এটি হয়রানি করতে করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কারা সেদিন মিছিল করেছে, সেটি তো ফেসবুকে লাইভেই আছে। তাদেরকে না ধরে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের ওপর কেন দোষ দেওয়া হচ্ছে?’
এমনকি রিপন দেব নামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক যুবককেও আসামি করা হয়েছে, যে ঘটনাটি নিয়ে গ্রামবাসী বিস্মিত।
আসামিদের মধ্যে দোয়ারাবাজার উপজেলা শ্রমিক লীগের সহসভাপতি আমরু মিয়ার দুই ছেলে, ছাত্রলীগ নেতা এমরান হোসেন ও শাহজাহান হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা আলীম হোসেন ও সুলতান আহমেদকে।
পুলিশ যে মামলা করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ৯০০ থেকে এক হাজার মানুষ মিছিল করেছিল।
অথচ সেই রাতে মিছিল নিয়ে ফেসবুকে লাইভও হয়েছিল। তবু পুলিশ ঠেকানোর উদ্যোগ নেয়নি।
এই বেপরোয়া হামলার সংবাদ দেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে আসেনি বললেই চলে। একটি অনলাইন সংবাদপত্রে কিছু সংবাদ প্রকাশ হয়েছে মাত্র।
তবে ফেসবুক পোস্টে যার নামে একটি কমেন্টকে ঘিরে উত্তেজনা, সেই হিন্দু যুবক আকাশ দাসকেই গ্রেপ্তার করা হয়, অথচ তার বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়।
পুলিশের পক্ষ থেকে আকাশের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। তবু এই আইনে কেন মামলা, সে বিষয়ে পুলিশ কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
গ্রামবাসীর নিরাপত্তার কথা ভেবে আকাশকে নিজেরাই পুলিশের কাছে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বড় ভাই প্রকাশ দাস। তিনি বলেছেন, ‘প্রশাসনের লোকজন এসে ঘটনাটি বলার পর আমি ঘরে ঢুকে দেখি আকাশের মোবাইলটি চার্জে রয়েছে। সে মোবাইল চার্জে রেখে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল। আমরা নিজেরা তাকে খোঁজে এনে পুলিশের কাছে দেই। সে তখন জানত না কেন প্রশাসনের লোকজন এসেছে।’
আকাশকে ছিনিয়ে নিতেও সেদিন পুলিশের ওপর আক্রমণ হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারাই হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটে জড়িত ছিল।’