বিএনপির বাধায় এর আগে রাজনৈতিক দল গঠন ও রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ভন্ডুল হয়েছে। এবারও সংবিধান কবর দেওয়ার ঘোষণার বিরোধিতা করছে বিএনপি।
বাংলা নিউয নেটওয়ার্ক স্পেশাল
৩১ ডিসেম্বর সংবিধানের ‘কবর’ রচনার ঘোষণা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে যে ফাটলের ইঙ্গিত মিলেছিল, সেটি আরও স্পষ্ট হয়েছে।
জুলাইয়ে সরকার পতন আন্দোলনকে বিপ্লব ধরে পাঁচ মাস পর ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বলেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তবে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে সরকারই একটি ঘোষণাপত্র দেবে। এরপর ছাত্র আন্দোলনের তরফে যে বক্তব্য এসেছে, তাতে মঙ্গলবার শহীদ মিনারে যাওয়ার কথা বলা হলেও ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে কিনা সেটি স্পষ্ট করা হয়নি।
জুলাইয়ের এই আন্দোলনকে নাগরিক কমিটি ‘বিপ্লব’ বললেও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর একে বলছে, ‘গণঅভ্যুত্থান’।
রাজনৈতিক দল গঠন ও রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যাওয়ার পর এই ঘটনাটি মুহাম্মদ ইউনূস ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সরকারের তরফে সমর্থন না পেলে তাদের ঘোষণা কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, এ নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
মঙ্গলবারের কর্মসূচি ঘিরে দিনভর প্রচার চালিয়েছিল জাতীয় নাগরিক কমিটি। সারা দেশ থেকে লোকজনকে ঢাকায় জড়ো করার কথাও বলা হয়। তার আগের দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, তারা ১৯৭২ সালের সংবিধানের কবর রচনা করবেন। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে ‘নাৎসি বাহিনীর’ মত ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ঘোষণা করার কথা বলেন।
তবে বিষয়টি যে সহজ হবে না, সেটি রোববার সরকারের এবং বিএনপির বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়, এই ঘোষণার সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিএনপির প্রতিক্রিয়া ছিল আরও কড়া। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সাফ জানিয়ে দেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া সংবিধানের কবর রচনার মত বক্তব্য তাদের পছন্দ নয়।
এতেই প্রকাশ হয়, বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের দ্বিমত তৈরি হয়েছে, তার বিএনপি যেভাবে গত অক্টোবরের শেষে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের চেষ্টা ঠেকিয়ে দিয়েছিল, সেটা তারা এবারও ঠেকিয়ে দেবে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যা বলল
এই টানটান উত্তেজনার মধ্যে রাত ৯টায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ও উপপ্রেস সচিবরা।
সেখানে প্রধান উপদেষ্টার একটি বার্তা পড়ে শোনান প্রেস সচিব শফিকুল আলম। পরে প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ থেকেও সেটি পোস্ট করা হয়, যার মোদ্দা কথা হল, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র সরকারই তৈরি করবে। সেটি ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেই তৈরি করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে ফেসবুক পোস্টে লেখা হয়, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে।’
গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত হবে বলেও লেখা হয় এতে।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর লিখেছে, ‘আমরা আশা করছি, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।’
শহীদ মিনারে জমায়েত হবে
সরকারের তরফে এমন বক্তব্য আসার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে বৈঠক হয় প্রায় তিন ঘণ্টা।
রাত একটার দিকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি জানান, বছরের শেষদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাদের কর্মসূচি হবে।
কথিত বিপ্লবের ‘ঘোষণাপত্র’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই দলিল যেন আমরা উপস্থাপন করতে না পারি সেজন্য নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে আমরা প্রাথমিকভাবে বিজয় অর্জন করেছি।’
‘আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা অবশ্যই শহীদ মিনারে একত্রিত হব। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্র আসবে, কিন্তু তাই বলে আমাদের একত্রিত হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে না।’
আপনারা ঘোষণাপত্র দেবেন কি না-এই প্রশ্নে মাসউদ বলেন, ‘আমরা প্রক্লেমেইশনের পক্ষে শহীদ মিনারে অবস্থান নেব।’
পাঁচ মাস পর ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ কেন
এটি আসলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের অনুকরণে একটি বিষয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পর ১০ এপ্রিল ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে যুদ্ধ করেছে দেশবাসী। এখানে সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে নানা ঘটনাপ্রবাহে সরকার পতনের পাঁচ মাস পর একে কথিত বিপ্লব হিসেবে ধরে নিয়ে ঘোষণাপত্র দেওয়া বাসনা প্রকাশ করা হয়।
এই আলোচনা আবার তৈরি করা হয় হুট করেই ২৮ ডিসেম্বর। সেদিন হঠাৎ করেই ‘থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বর, নাও অর নেভার’ বলে একটি বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক থেকে সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেওয়া আসিফ মাহমুদ লেখেন, তারা জুলাই ‘বিপ্লবের’ ঘোষণাপত্র দেবেন।
তবে দেশ পরিচালনায় চরম ব্যর্থতার কারণে দেশবাসীর সমর্থন যে আর আগের মত নেই, সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠে সামাজিক মাধ্যমে এই ঘোষণাপত্রের পক্ষে কথা বলা ব্যক্তিদের বক্তব্যেই। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে থাকেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন না থাকলে এটি কতটা কাজ করবে।
প্রশ্ন হল, অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণের প্রায় পাঁচ মাস পর কেন বিপ্লবের ঘোষণাপত্র এবং সংবিধান বাতিলের উদ্যোগ।
আসলে গত ৮ আগস্ট সংবিধান সংরক্ষণ এবং সংবিধান অনুযায়ী চলার অঙ্গীকারই করেছে সরকার। ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকারে আসা তিন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমও তাই করেছেন।
সংবিধানে বলা আছে, সংসদ ভেঙে দিলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। সেটা করা না গেলে বড়জোর আর ৯০ দিন সময় নেওয়া যায়। অর্থাৎ আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে।
আবার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার আদেশ এসেছে। এটি আরও লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি করতে যাচ্ছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল যদিও বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারই তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু সংবিধানের বিধান অনুযায়ী এই সুযোগ আছে কি না তা নিয়ে আছে সন্দেহ।
কারণ, এই বিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। তিনি রাজি না হলে অন্য অনেক ধাপ পেরিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাউকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। তার মানে মুহাম্মদ ইউনূসের এই সরকারের প্রধান হওয়া অত্যন্ত কঠিন।
আবার উপদেষ্টা পরিষদ হতে হবে ১০ সদস্যের। তাদের কারও বয়স ৭২ হওয়া চলবে না আর সেই সরকারকে অবশ্যই ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সংবিধানে আর কোনো বিকল্পই নেই।
২০০৭ থেকে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন দিতে পেরেছিল, কারণ সে সময় রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করে সংবিধান স্থগিত করেছিলেন।
অর্থাৎ সংবিধান এখন সরকারের সদস্যদের জন্য যখন ভবিষ্যতে জবাবদিহিতার এবং শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে, সে সময় তারা সংবিধানের কবর রচনা এবং ‘বিপ্লবের’ ঘোষণাপত্রের কথা বলছে।
তবে অক্টোবরের শেষ দিকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ বিএনপির বিরোধিতায় ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর এই বিষয়টি নিয়ে আর মুখই খুলছে না ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সে সময় তারা জোরের সঙ্গেই বলেছিল, ‘চুপ্পু (রাষ্ট্রপতির ডাক নাম) মাস্ট গো’।