অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মুছে দেওয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। তার মতে বাংলাদেশের বর্তমান মানচিত্র খণ্ডিত। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ও সেভেন সিস্টারস নামে সাত রাজ্য জুড়ে দিয়ে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘৭১ থেকে ২৪ শেষ নয়, ইতিহাস এখনো অপেক্ষমাণ।’

ছিনতাইকারীর প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে, হামলা, লুটপাটে গ্রাম কি গ্রাম লন্ডভন্ড হচ্ছে, ভেঙে পড়েছে শৃঙ্খলা; কেবল বেক্সিমকো গ্রুপের ৪০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারাচ্ছেন, শ্রমজীবীদের আয়ে টান, টাকা দিতে পারছে না বেশ কিছু ব্যাংক, তাতে বেতন আটকে গেছে লাখো মানুষের, জীবন হচ্ছে দুর্বিষহ, কিন্তু দেশের এসব সংকট ছাপিয়ে আলোচনায় ভারত।

পাহাড়সম ব্যর্থতাকে আড়াল করতে মোক্ষম একটি অস্ত্র হাতে নিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭ সাল থেকে যে বাগ্‌যুদ্ধ তৈরি হয়েছে, তার আরেকটি ফ্রন্ট খোলা হয়েছে বাংলাদেশে।

এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম দীর্ঘ ফেসবুক পোস্ট দিয়ে ভারতের কাছ থেকে ভূমি নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠনের কথা বলেছেন। তার দৃষ্টিতে এখনকার বাংলাদেশ খণ্ডিত। তিনি অখণ্ডিত বাংলাদেশ চান।

এসব বক্তব্যে অবশ্য লাভ হচ্ছে, ব্যাংকে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না সেসব নিয়ে আলোচনা নেই, সার সংকটে দিশেহারা কৃষক, তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, কুমিল্লা নোয়াখালীতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কিছুই করেনি সরকার, তা নিয়ে আলোচনা নেই, শ্রমিক বিক্ষোভে নাকাল দেশ, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিল্প কারখানা, তা নিয়ে আলোচনা নেই, হিন্দুদের ওপর আক্রমণ নিয়েও এখন আলোচনা নেই, চার দিকে কথা কেবল ভারত, ভারত আর ভারত।

প্রায় প্রতি সপ্তাহে উপদেষ্টারা ভারতের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে উত্তেজিত করছেন তাদের সমর্থকদের, আর মাঠ পর্যায়ে আছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

বাগ্‌যুদ্ধ শুরু বাংলাদেশ থেকেই

ভারতের কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের বিষয়ে অতিরঞ্জিত বক্তব্য যেমন আসছে, তেমনি এটাও সত্য যে, এই উত্তেজনাটি তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই।

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশি একটি সংবাদ মাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলে আসেন, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে অস্থিতিশীল হবে ভারতের সেভেন সিস্টারস।

তখন থেকেই ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা সেভেন সিস্টার দখল করে নেওয়ার কথা বলতে থাকেন, সেসব বক্তব্য আসে সংবাদ মাধ্যমেও।

গত ২২ আগস্ট টিএসসিতে ত্রাণ সংগ্রহের সময় বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ভারতের চিকেন নেক নামে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ে হুমকি দেন।

সেদিন তিনি বলেন, ‘আমরা ভারতকে বলছি আপনারা সতর্ক হোন। আপনারা যদি মনে করে থাকেন আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ ব্যাহত করার জন্য আপনারা বাংলাদেশের মানুষকে সংকটের মধ্যে ফেলবেন, আমরা বলব আপনারা চিকেন নেকের কথা ভুলে যাবেন না। আপনারা আমাদের যেভাবে ট্রিটমেন্ট দেবেন, ঠিক একইভাবে আপনারাও ট্রিটমেন্ট পাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন।’

২৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা স্লোগান ধরেন, ‘আমরা সবাই বাবর হব, সেভেন সিস্টার স্বাধীন করব।’

এই বাবর হলেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফাকে সহযোগিতার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় তার মৃত্যুদণ্ডও হয়।

এতসব ঘটনার পরেও সরকার, ছাত্র আন্দোলন, বিএনপি, জামায়াতের তরফে ভারত সরকারকেই উত্তেজনা তৈরির জন্য দায়ী করা হচ্ছে, অথচ ভারত সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশকে নিয়ে কোনো আপত্তিকর কথা বলেছেন, এমন প্রমাণ নেই।

দুই দেশেই সামাজিক মাধ্যমে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের বাদানুবাদে এক পক্ষ আরেক পক্ষের ভূখণ্ড দখল করে নেওয়ার কথা বলছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যেমন ভারতের সেভেন সিস্টার দখল করে নেওয়ার কথা বলে উত্তেজনা ছড়িয়েছে, চিকেন নেকে হামলার কথা বলেছে, তেমনি ভারতের বাংলাভাষাভাষী একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এক উপস্থাপক রংপুর ও চট্টগ্রাম দখলের কথা বলেছেন।

ভারতের পূর্বাঞ্চল ‘দখলের হুমকি উপদেষ্টা মাহফুজের

বিষয়টি সামাজিক মাধ্যম বা সংবাদ মাধ্যমে সীমিত রাখলেন না দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম যাকে এবারের আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলে নিউ ইয়র্কে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস।

বিজয় দিবস শেষে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম যে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দেন, যার মোদ্দা কথা হল, বাংলাদেশের যে মানচিত্র, সেটি পূর্ণাঙ্গ নয়। তিনি পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সবগুলো রাজ্য যুক্ত করে সেটি পূর্ণাঙ্গ করতে চান।

দীর্ঘ স্ট্যাটাসে একটি মানচিত্রও পোস্ট করেন মাহফুজ, তাতে হেয়ালি করে লেখেন, ১৯৭১ বা ২০২৪ই শেষ কথা নয়।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারীরা ঢাকাসহ দেশের নানা এলাকায় এমন মানচিত্র এঁকে রেখেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মানে বাংলাদেশের মন্ত্রী পর্যায়ের একজন ব্যক্তির তরফে এমন বক্তব্য দেখে হতভম্ভ হয়েছে মানুষ।

এই ধরনের নজিরবিহীন হুমকি এর আগে কেউ কখনও দেখেনি। এই ঘটনায় ভারত থেকে প্রতিক্রিয়া এলে নিশ্চয় আবার সরকারের তরফে কথা বলা হবে, ছাত্র আন্দোলন মিছিল সমাবেশ করবে।

মাহফুজ আলম লিখেছেন, ১৯৪৭ সালে হিন্দু মৌলবাদী ও কুলীনদের (অখণ্ড) বাংলাবিরোধিতা থেকে ‘পোকায় খাওয়া’ খণ্ড বাংলাদেশের জন্ম হয়।

তিনি আরও খিলেছেন, ‘নতুন ভূগোল ও বন্দোবস্ত লাগবে।’

তার মতে ‘খণ্ডিত ভূমি’ ও একটা জন্মদাগ নেয়া রাষ্ট্র দিয়ে হয় না, সে ভূমি ও রাষ্ট্রের সভ্যতাগত আকাঙ্ক্ষা ও রূপান্তর আর সাংস্কৃতিক হেজেমনি লাগে।

উপদেষ্টা আরও লিখেছেন, ১৯৭৫ ও ২০২৪ সালে দুইবার সুযোগ আসলেও তারা ৭২ এর মুজিববাদী বন্দোবস্তকে পুরোপুরি নস্যাৎ করতে পারেননি।

শেষে তিনি ভারত থেকে ভূখণ্ড কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিয়ে লেখেন, ‘বাংলাদেশ শুরুর বিন্দু, অন্তবিন্দু নয়। ’৪৭ হয়ে ৭১ থেকে ২৪ শেষ নয়, ইতিহাস এখনো অপেক্ষমাণ।’

এর মাঝে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার ধারাবাহিকতায় যে ২০২৪ সালের আন্দোলন, সেটিও স্বীকার করে নেন মাহফুজ। তিনি লেখেন, ‘রাষ্ট্রের জন্ম দাগ তথা ভারত নির্ভরতা ও ভারতের আধিপত্য মুক্ত রাখতে ’৭৪ ও ’২৪ ঘটাতে হয়েছে।’

তবে জেহাদি এই বক্তব্য দিয়ে ফেসবুক পোস্টটি বেশিক্ষণ রাখেননি বা রাখতে পারেননি মাহফুজ আলম। তিনি সেটি মুছে দিয়েছেন। কেন মুছেছেন, এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেননি।

দিনভর সরকারের উপদেষ্টারা অনেক কথা বললেও মাহফুজের ভারত দখলের হুমকি নিয়ে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি, বিস্ময়কর হলো, সংবাদকর্মীরা কিছু জিজ্ঞেসও করেননি।

একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনলাইন বিভাগে মাহফুজ আলমের এই স্ট্যাটাস দেওয়া ও তা ডিলিট করা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলেও তারা নেই সংবাদও তুলে দিতে বাধ্য হয়। কেন সংবাদটি তুলে নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।

মোদির টুইট নিয়েও উত্তেজনা তৈরির চেষ্টার কী যুক্তি?

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতও বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের জন্যও যুদ্ধ। ৩ ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনী সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান শুরু করে।

৪ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার বাংলাদেশের সব সেক্টর, সব বাহিনী ও ফরমেশনকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে থেকে যুদ্ধ করার আনুষ্ঠানিক নির্দেশ দেয়। অর্থাৎ দুই দেশের যৌথ বাহিনী গঠন হলেও তার নেতৃত্বে ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীই।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কাছেই।

ফলে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় নিশ্চিত হলেও সেটি ভারতেরও একটি নিরঙ্কুশ বিজয়। আর আত্মসমর্পণের এই দলিল কিন্তু ভারতের কাছেই আছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে তাদের উল্টা করা যে পতাকা হস্তান্তর করে, সেটি ভারতের কাছেই করে।

বিজয় দিবসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট করে তার দেশের সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে লেখেন, ‘আজ বিজয় দিবসে আমরা সেই সাহসী সৈনিকদের সাহস ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানাই, যাঁরা ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রেখেছিলেন। তাঁদের নিঃস্বার্থ নিষ্ঠা ও অটল সংকল্প আমাদের জাতিকে সুরক্ষিত করেছে এবং আমাদের গৌরবে ভরিয়ে দিয়েছে। এই দিনটি তাঁদের অসামান্য বীরত্ব ও অবিচল মানসিকতাকে শ্রদ্ধা জানানোর দিন। তাঁদের আত্মত্যাগ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে চিরদিনের জন্য গভীরভাবে গেঁথে থাকবে।’

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ কোনো স্বাধীন দেশ ছিল না। সে সময় বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম পৃথিবীর কাছ মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হিসেবে বিশ্ব ইতিহাসে এর স্থান তৃতীয় পাক-ভারত যুদ্ধেরই।

নরেন্দ্র মোদি এখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে তাদের যুদ্ধের কথা সামনে আনার পর বাংলাদেশে এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এই উত্তেজনায় ঘি ঢালছেন উপদেষ্টারা।

প্রথমে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও পরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন কথা বলেছেন এ নিয়ে। 

আসিফ নজরুল পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, ‘তীব্র প্রতিবাদ করছি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। ভারত ছিল এই বিজয়ের মিত্র, এর বেশি কিছু নয়।’

তৌহিদ হোসনে বলেছেন মোদির পোস্টের প্রতিক্রিয়া জানাবে ঢাকা। অথচ মোদির পোস্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গই নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here