গতকাল ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি প্রধান সংবাদ ছিল চিন্ময় কৃষ্ণদাসের আইনজীবী এডভোকেট রমেন রায়ের উপর হামলা। তার সারা শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর চিহ্ন। তিনি এখন একটি হাসপাতালের আইসিউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। বাংলাদেশের কোনো মিডিয়ায় এ সংবাদ নেই, অথচ ভারতীয় মিডিয়ার প্রধান শিরোনাম!
মুর্মুষু আইনজীবী রমেন দাস হাসপাতালের বিছানায়, ছবি ঘুরপাক খাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বলা হচ্ছে, চিন্ময়ের পক্ষে জামিন শুনানীতে অংশ নেয়া এডভোকেট রিগ্যান আচার্য্যকেও মারধর করা হয়েছে। তার চেম্বার ভেঙে তছনছ করা হয়েছে। এমতাবস্তায় কোন আইনজীবীই পাচ্ছেন না তিনি। যেসব আইনজীবী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জন্য শুনানী করেছিলেন তাদের সবাইকে হুমকি দেয়া হয়েছে। ১১৪ জন হিন্দু আইনজীবীর নামে মামলা দেয়া হয়েছে।
এ সব খবর অনেকাংশে সত্য; কিছু অংশ সত্য নয়। যেমন আমি জেনেছি, রমেন বাবুকে কোপানো হয়েছিল নভেম্বরের ২৫ তারিখ শাহবাগে। ঐদিন চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করার পর প্রতিবাদের জন্য শাহবাগে অবস্থান নিয়েছিলেন তার অনুসারীরা। সেখানে জাতীয়তাবাদী যুবদলের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছিল। চাপাতি ও লাঠিসোটার আকষ্মিক হামলায় বহু প্রতিবাদী হিন্দু সেখানে আহত হন। হিন্দুদের চলমান আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষনেতা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের সহযোগী অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তীও সেখানে মারাত্মকভাবে যখম হন। একই দিন রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের উপর নির্মম হামলা পরিচালনা করা হয়। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের মিডিয়া সে সংবাদ চেপে গেছে।
এ অবস্থায় ভারতীয় মিডিয়া যখন বলছে চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীর উপর হামলা হয়েছে, তিনি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন, তখন বাংলাদেশের মিডিয়া ও সরকারের জন্য আসল ঘটনা প্রকাশ করাটা বিব্রতকর। মিডিয়া আজ কোন মুখে বলবে, আইনজীবী রমেনকে যুবদলের কর্মীরা কুপিয়েছিল ২৫ নভেম্বর –যা আমরা গোপন রেখেছিলাম?
ভারতের ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রাত্যহিক পাঠক প্রায় ১ কোটি ৩৫ লক্ষ। বাংলাদেশের সবগুলো মিডিয়া একত্রিত করে ৫০ লাখ পাঠক হবে না। তাহলে বৈশ্বিক মিডিয়া ক্যাম্পেইনের দৌড়ে তাদের সঙ্গে আমাদের পাল্লা কতক্ষণ টেকে? সত্য গোপন করে লাভ কী? ভারতের সকল পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচালিত ভিডিও ব্লগে গতকালের অন্যতম ফোকাস ছিল চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীর উপর হামলার খবর। তাহলে বাংলাদেশে মিডিয়া বিষয়টি ডার্কে রেখে কি উপকার হল? শুধু বাংলাদেশের জনগণকে অন্ধকারে রেখে দেশের কোনো লাভ হচ্ছে?
সারাদেশে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও হিন্দুদের উপর হামলা, বাড়িঘর ও উপাসনালয়ের ক্ষতি সাধনের খবর আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়া তা গোপন করছে। এতে দেশের কী উপকার হচ্ছে বোধগম্য নয়।
বাংলাদেশ একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে এবং আরও গুরুতর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিদেশের সঙ্গে খেলে নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার নজির বিভিন্ন দেশে আছে। যে দেশে এমন হয়েছে, সেই দেশের সর্বনাশ হয়েছে।
বাংলাদেশে এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার জাতীয় ঐক্য। হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ঐক্য নয়, দেশপ্রেম নিয়ে জাতি-ধর্ম-রাজনীতি নির্বিশেষে সবার ঐক্য। সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচার করে সে ঐক্য সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখেও সে ঐক্য সম্ভব নয়। অভ্যন্তরীণ শত্রুতা ঘনিভূত করে খেলা দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে দেশের সর্বনাশ।
দাঙ্গা করে দেশের দেড় কোটি হিন্দুকে মেরে ফেলতে পারবেন না। তাতে সমস্যা সমাধান হবে না। সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধান করে হিন্দু সমাজের আস্থা পুনরুদ্ধার করা বরং দুই দিনের ব্যাপার। সরকার চাইলেই এটা পারে। সদিচ্ছা লাগবে। দমন-নিপীড়ন বন্ধ করে হিন্দু সমাজের নেতৃবৃন্দের সাথে বসতে হবে। যে আট দফা দাবিতে হিন্দুরা আন্দোলন করছে তা পুরণ করা কঠিন কিছু নয়। সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠনসহ ঐ আট দফায় যা আছে তার অনেকগুলোই হালকা বিষয়, যা হিন্দুদের তেমন কোনো উপকারে আসবে না। দাবি অনুযায়ী সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন করলে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তার বশংবদ কোনো এক নিকৃষ্ট দালাল হয়তো সেখানে মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবে। এর বেশি না। এতে হিন্দুদের কী উপকার হবে জানি না। তার চেয়ে বেশি দরকার চাকরি ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রতি চরম বৈষম্য নিরসন করা। একটি দাবি বিশেষভাবে পুরণ হওয়া দরকার, তা হল সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন। এ ছাড়া অন্যগুলো তেমন কিছুই না।
সবচেয়ে বেশি দরকার আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা। আগস্টের ৫ তারিখ থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দুদের উপর প্রায় তিন হাজার হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর কোনটিতে অপরাধীরা গ্রেপ্তার হয়েছে বা বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সরকার কি বলতে পারবে? মিডিয়া কি বলতে পারবে? দেশজুড়ে সংখ্যালঘুর উপর হামলার ঘটনা গোপন করে দেশের মিডিয়া তার সাম্প্রদায়িক চরিত্র সংহত করা ছাড়া আর কিছু করছে না। দেশের ভাল করতে হলে সরকারের পাশাপাশি মিডিয়াকেও সৎ হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য সততা ও স্বচ্ছতার চেয়ে উন্নত পন্থা নেই।
আবার বলছি, জাতীয় ঐক্য দরকার। জাতীয় ঐক্যের ঠিকানা ৭১এর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে রাজনীতি করলে আপনি নিছক ঐক্যবিনাসী; আপনি দেশের জন্য ক্ষতিকর। হিন্দু-মুসলিম অশান্তির উপর রাজনীতি করলে আপনার মতলব ভাল নয়।