মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, লেখক
ইতিহাস একথাই বলে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসকে এই এক কথায় বেঁধে দিলে সত্যের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ঘটে না। ইতিহাসের অপূর্ণাঙ্গ উপস্থাপনও এক ধরনের ইতিহাস বিকৃতি। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের বাইরে অপর যে রাজনৈতিক শক্তির একটি মূল ও অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল সে হলো কমিউনিস্ট পার্টি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের।
পটভূমি গড়ে তোলার কাজে :
————————————
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেবল নয় মাসের একটি ‘সামরিক অভিযান’ ছিল না। তা ছিল দুই যুগ ধরে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের সামগ্রিক ইতিবাচক উপাদানসমূহের নির্যাস, তার শীর্ষ অধ্যায়। তাই দুই যুগের গণসংগ্রাম হলো আমাদের মুক্তি সংগ্রাম তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুক্তিযুদ্ধের এই সার্বিক বিস্তৃতিকালের সূচনা লগ্ন থেকে শেষ পর্যন্ত এ দেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা অনন্য অবদান রেখেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এবং সময়ে সময়ে এই অবদান ছিল নির্ধারক, ক্রান্তিকালীন এবং এমনকি নেতৃত্বমূলক।
সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যে নিপীড়নমূলক, অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ও শোষণমূলক অধ্যায়ের সূচনা হয় তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়েছিল এদেশের কমিউনিস্টরাই। তাদের বিরুদ্ধে জেল-জুলুম, গ্রেফতার-নির্যাতন, হুলিয়া-মামলা, হত্যা-নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে যায় প্রথম দিন থেকেই। এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে কমিউনিস্টরা প্রায় এককভাবে সূচনা করে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার, বাঙালির জাতীয় আত্মপরিচয় ও গণমানুষের রুটি-রুজির সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। নব পর্যায়ের এই সংগ্রামে প্রথম শহীদ হন কম্পরাম সিংহ, হানিফ, বিজন, দেলোয়ার, সুখেন, সুধীন, আনোয়ারসহ ৭ জন কমরেড, ঢাকা জেলে অনশন সংগ্রামে জীবন দেন শীবেন রায়। কারাগারগুলো ভরে তোলা হয় কমিউনিস্ট বন্দিদের দিয়ে। রক্ত ঝরে নাচোলে, তেভাগা সংগ্রামের প্রান্তরে, গারো পাহাড়ের পাদদেশে সশস্ত্র টংক-আন্দোলনে, সিলেটের নানকার বিদ্রোহের ময়দানে। সে সময় কমরেড রনদীভের নেতৃত্বে বাম হটকারী লাইন অনুসরণ করে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুয়া হ্যায়’- শ্লোগান নিয়ে রচিত হয় জঙ্গি ও সাহসী সংগ্রামের এক অম্লান অধ্যায়।
সংগ্রামের এই পর্বের অল্পকাল পরেই কমিউনিস্ট পার্টি বাম হটকারী লাইন পরিত্যাগ করে। ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়…শ্লোগান প্রত্যাহার করলেও পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে তারা মোটামুটি আগাগোড়াই এই বিবেচনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছে যে, পাকিস্তানের বাস্তবতার মধ্যে তাদেরকে কাজ করতে হবে ঠিকই, কিন্তু একথাও সাথে সাথে হিসেবে রাখতে হবে যে, জাতীয়তা ও রাষ্ট্রের সংজ্ঞার বিচারে পাকিস্তান একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। এ ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল ও কৃত্রিম ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে একটি দেশের অস্তিত্ব স্থায়ী হতে পারবে না।
পাকিস্তানি যুগের একেবারে প্রথম লগ্নে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের যে আলোক শিখা কমিউনিস্টদের একক প্রচেষ্টায় জাগিয়ে রাখা হয়েছিল, তা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মুসলিম লীগের একটি প্রভাবশালী অংশ ভাসানী-সারোয়ার্দ্দীর নেতৃত্বে দল থেকে বেড়িয়ে এসে আওয়ামী লীগ গঠন করে। ৪৮ থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন ৫২-তে এক মহাবিদ্রোহে পরিণত হয়। কমিউনিস্ট, বামপন্থী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তি সম্মিলিতভাবে গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন, অসাম্প্রদায়িকতা, রুটি-রুজির জন্য আন্দোলন বেগবান করে। ৫৪-তে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট, রচিত হয় ঐতিহাসিক ২১-দফা। নির্বাচনে ভরাডুবি হয় মুসলিম লীগের। আবার নতুন ষড়যন্ত্রের খেলা শুরু হয়। ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে অপসারণ করা হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীত্ব-মন্ত্রীত্ব পদ প্রদানসহ নানা প্রলোভন প্রদান করে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে স্বায়ত্তশাসন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নীতি থেকে সরিয়ে আনতে পাকিস্তানি মার্কিনি শাসকরা সক্ষম হয়। সে সময়ই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আত্মসমপর্ণকারী নীতির বিরোধিতা করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়।
একের পর এক ষড়যন্ত্র করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি শাসকরা ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন বলবৎ করে। সূচনা করে আইউবী শোষণ-নিপীড়নের কালো অধ্যায়। আবার শুরু হয় গ্রেফতার, নির্যাতন, বেত্রাঘাত ইত্যাদি। আঘাত আসে সব গণতান্ত্রিক শক্তির উপর। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আঘাত আসে অকুতোভয়, দৃঢ়চেতা, আপসহীন ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মীদের উপর। জেলে বেশিরভাগ তারাই। কারো কারো বন্দি জীবন ১/২/৩ দশক ধরে চলেছে। অন্যরা আসে যায়, কিন্তু কমিউনিস্টরা থেকেই যায়। অন্যান্যদের অভ্যর্থনা ও বিদায় জানানোই যেন তাদের কাজ। মার্শাল’ল কোর্টের বিচারে বেত্রদ-, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাস্ট্রিকেশন, হুলিয়া-গ্রেফতারি পরোয়ানা এসব যেন অন্য কারো জন্য নয়, বরাদ্দ শুধু কমিউনিস্ট ও ন্যাপের জন্য।
এর মাঝেই পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হতে থাকে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সেই সংগ্রামেরও সামনে দাঁড়িয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ। সেই সাথে আওয়ামী লীগও। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র লীগ সমানে সমানে শক্তি নিয়ে সংগ্রামের অগ্রভাগে। রচিত হয় ’৬২, ’৬৪, ’৬৬-র আন্দোলন। ’৬৯ সালে গড়ে ওঠে গণঅভ্যূত্থান। পতন হয় আইয়ুব শাসনের। এই সময়টাতেই, ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে, গণতন্ত্র, বাঙালির স্বাধিকার, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিত, রুটি-রুজির সংগ্রামের দৃঢ়চেতা বৃহৎ শক্তি কমিউনিস্ট ও ন্যাপে আসে বিভেদ ও বিভ্রান্তি। আন্তর্জাতিক কয়েকটি ইস্যু, মতাদর্শতার কতক প্রশ্ন, আইয়ুব শাসনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক উভয় দলের মধ্যে স্থায়ী বিভক্তির জন্ম দেয়। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি গণসংগঠনগুলোও বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তি এবং আইয়ুব সরকারের প্রতি স্বাধীনতার দাবির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নানা মাত্রা ও রূপের বিভ্রান্তি বামপন্থী শিবিরের কর্মক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। এতদিন ধরে চলে তাদের চলে আসা অগ্রবর্তী ভূমিকাকে এই বিভক্তি বহুলাংশে খর্বিত করে। ঠিক যেই সময়টাতে স্বাধীনতার দাবিতে সংগ্রাম অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে, সে সময়টাতেই বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী শক্তির মধ্যে এতদিনের প্রায় সমানে-সমানে ভারসাম্য বামপন্থীদের বিরুদ্ধে চলে যায়। জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ ও তার নেতা বঙ্গবন্ধু এক নম্বর শক্তিতে পরিণত হয়। এই পটভূমিতেই অনুষ্ঠিত হয় ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে বাঙালির একক প্রতিনিধি বেছে নেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে দেশবাসী বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকেই বেছে নেয়। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের দ্বিতীয় কাতারে থেকে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হয়।
প্রস্তুতিপর্বে :
—————
১৯৬৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্টরা প্রাদেশিক সম্মেলনে মিলিত হয়ে সেই সম্মেলনকে পার্টির প্রথম কংগ্রেস হিসেবে ঘোষণা করে। এ কংগ্রেসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। কংগ্রেস ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ স্বাধীনভাবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদনের রণকৌশল গ্রহণ করে। স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে এভাবে মূর্তভাবে দৃষ্টির মধ্যে নিয়ে আসা হয়। তবে বলা হয় যে, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও স্বাধীনতা একই সাথে আসবে। ’৬৯-এর গণঅভ্যূত্থানের পর পাকিস্তানের এক দশক থেকে চলে আসা আইয়ুবী স্থিতিশীলতার প্রাসাদ ভেঙে পড়ে। রাজনীতিতে একটা তরল অবস্থা সৃষ্টি হয়।
’৭১-এর শুরুতেই ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে মিলিত হয়ে সংঘঠনের ঘোষণাপত্রে বাঙালিসহ পাকিস্তানের সকল জাতির জন্য ‘বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারসহ পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারির সমাবেশ থেকে ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা হুঁশিয়ারি জানিয়ে ঘোষণা করেন নির্বাচনের রায় বানচাল করার চেষ্টা হলে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করে গণরায় বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টিও একই ধারায় অগ্রসর হয়। অনেক বছর পর গোপন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন মূর্ত রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রস্তুতি গ্রহণে সেøাগান নিয়ে তারা নেমে পড়ে। এরপর প্রতিটি দিন ছিল স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়া ও এর পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য সম্ভবমতো প্রস্তুতি গ্রহণের কাল।
কমিউনিস্ট পার্টির আত্মগোপনকারী নেতা এবং ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা একত্রে বসে নানা প্রস্তুতিমূলক কাজ এগিয়ে নিতে থাকেন। প্রতিদিন বিকেলে শহীদ মিনার থেকে জনগণের উদ্দেশ্যে আহ্বান ও নির্দেশাবলি প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রয়াত সোলায়মান খানের বাসায় বসে ঢাকা শহরকে সেনা আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে, এখন যাকে একেবারেই ছেলেমানুষী ধরনের মনে হয়, সে ধরনের কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে ছিল রাস্তার পাশে বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে মরিচের গুঁড়া, ভাতের ফ্যান ফেলে, রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে পাকিস্তানি ফৌজকে আটকানো, মলোটভ ককটেল দিয়ে ট্যাংক বাহিনীর ওপর আত্মঘাতী হামলা ও রাস্তা কেটে ট্যাংক চলাচল আটকে দেয়া ইত্যাদি নানা পরিকল্পনা।
ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মার্চের ৩ তারিখ থেকে পাড়ায় পাড়ায় জঙ্গি কর্মী বিগ্রেড গঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ডামি রাইফেল হাতে প্রতিদিন প্রকাশ্য কুচকাওয়াজ ও ঢাকার রাজপথে প্যারেড ইত্যাদি শুরু হয়। ঢাকার দেখাদেখি একে একে জেলাগুলোতেও এ প্রস্তুতির কাজ বিস্তার লাভ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ল্যাবরেটরির কেমিকেল দিয়ে উচ্চমানের বিস্ফোরক তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকে। কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বাবধানে ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী নির্জন এলাকায় রাইফেল নিয়ে লাইভ ফায়ারিং প্র্যাকটিস শুরু করা হয়। এসব আয়োজন চলতে চলতে নেমে আসে ২৫ মার্চের কালো রাত্রি। আধুনিক পাক সেনাবাহিনীর বর্বর অভিযান ও নির্বিচার গণহত্যার মুখে একথা তৎক্ষণাৎ স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হানাদার বাহিনীকে রুখতে হলে আরো উন্নত, দক্ষ ও পেশাদারী প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলে প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে। সূচনা করতে হবে সশস্ত্র মুক্তিযুুদ্ধ।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ :
——————–
প্রত্যক্ষ সশস্ত্র লড়াইসহ মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবা কাজগুলো এগিয়ে নিতে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন সমন্বিতভাবে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সব শক্তিকে একত্রিত করার জন্য এবং জনগণের ঐক্যকে সুসংহত রাখার জন্য ধৈর্য্য ও নিষ্ঠার সাথে তারা আগাগোড়া চেষ্টা চালায়। অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই তারা নিজস্ব উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব কাজে সর্বশক্তি নিয়োজিত করে। একসময় অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের উপদেষ্টাম-লী গঠন করা হলে সেই কমিটির সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতারা ছাড়াও কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, মওলানা ভাসানী এবং কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর অন্তর্ভুক্ত হন। এছাড়া মেনন-রনোর নেতৃত্বাধীন শক্তি ও আরো কিছু বামপন্থী শক্তির সাথে মূলধারার একটি সেতুবন্ধন গড়ে তোলার জন্যও কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয়। অক্টোবর মাসের দিকে এফএফ, বিএলএফ, বিশেষ গেরিলা বাহিনী প্রভৃতি পৃথক পৃথক গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়-তার পেছনে একটা প্রধান উদ্যোগ ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের।
দেশের মুক্তাঞ্চলগুলোতে জনগণের ভেতরে কিভাবে কাজ করতে হবে তার নিদের্শনাসহ ‘ইশতেহার’ দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নামে পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রতিবেশী ভারতের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দৃঢ়ভাবে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন শহরে ন্যাপ-কমিউনিস্ট-ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা শহরে, বন্দরে, লোকালয়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক জনসভা ও সাধারণ সভায় বক্তৃতা করেন। উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে মানোবল সমুন্নত রাখার জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকা-সহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহযোগিতা সংগ্রহের জন্য কমিউনিস্টরা একটা বড় ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘ, শান্তি পরিষদ সম্মেলন, সমাজতান্ত্রিক দেশ, তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশে দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। কমিউনিস্ট পার্টিসহ প্রগতিশীলরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকায় এবং তাদের দেয়া তথ্য ও বিশ্লেষণে বিশ্ববাসীর কাছে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ যা ঘটছে তা কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়, এটা বস্তুত জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ধারায় বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
প্রত্যক্ষ সশস্ত্র যুদ্ধে প্রথমদিন থেকেই ন্যাপ-কমিউনিস্ট-ছাত্র ইউনিয়ন তার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা নিয়োজিত করে। দেশের ভেতরে সুযোগমতো প্রতিরোধের কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য তারা চেষ্টা করে। সাময়িকভাবে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলেও তারা সর্বত্রই গড়ে তোলে যোগাযোগের নেটওয়ার্ক। প্রথমদিকে গড়ে উঠা স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘মুক্তিবাহিনী’তে তরুণ কর্মীরা দলে দলে যোগদান করতে থাকে। পরে নানা সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয় প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, যা কখনো কখনো জীবনের হুমকি হিসেবেও আসত। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের অনেক তরুণ কর্মী বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে গঠিত এফএফ বাহিনীতে যোগ দিয়ে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে। ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনসহ বিভিন্ন এলাকার ঐতিহাসিক সাহসী অপারেশনগুলোতে বামপন্থী তরুণরা তাদের দেশপ্রেম, সাহস ও নিষ্টার প্রমাণ রেখেছে। মেরিন গেরিলা বাহিনীতেও অনেকে লড়াইয়ের কৃতিত্বের দ্বারা গৌরব অর্জন করেন। দেশের ভেতরেও স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং দিয়ে স্থানীয় ‘মুক্তিযোদ্ধা দল’ গঠন করে তারা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়।
মে মাসে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠনের কাজ শুরু হয়। জুন মাসের মধ্যে ৬ সপ্তাহের বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত এই বাহিনীর প্রথম দল প্রশিক্ষণ শেষ করে বেইস ক্যাম্পে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। এসব বিশেষ প্রশিক্ষণে পাঠানোর আগে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিভিন্ন স্থানে কয়েক ডজন ইয়ুথ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এসব ক্যাম্পে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের তত্ত্বাবধানে হাজার হাজার তরুণ রাজনৈতিক মতাদর্শগত ও প্রাথমিক ধরনের শারীরিক ও আধাসামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকে। জুলাই মাসের শেষ দিক থেকে বিশেষ গেরিলা বাহিনীর এসব সদস্য পৃথক পৃথক গেরিলা দলে বিভক্ত হয়ে দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান নিতে শুরু করে। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের চিন্তা মাথায় রেখে কাসিক্যাল গেরিলা কৌশল অবলম্বন করে এই দলগুলো নিজ নিজ ভিত্তিভূমি রচনা করতে শুরু করে। কিছু কিছু দল সেপ্টেম্বর মাস থেকে ছোটখাটো অপারেশন আরম্ভ করে।
একে একে ৪টি ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হতে হতে এসে পড়ে নভেম্বর মাস। তখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিতে পারে। নভেম্বরের মাঝামাঝির পর যুদ্ধের কায়দা বদল হয়ে সরাসরি মোকাবিলার কৌশল গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে উত্তরণের প্রক্রিয়া চলাকালেই ১১ নভেম্বর ঘটে যায় বেতিয়ারা যুদ্ধের ট্র্যাজেডি। যেখানে হানাদারদের সাথে সম্মুখ সমরে নিহত হন এই বিশেষ গেরিলা বাহিনীর ৯ জন বীর যোদ্ধা। ইতোমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত গেরিলা গ্রুপগুলো প্রত্যক্ষ ‘অপারেশন’-এর কাজ বাড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ তার চূড়ান্ত অধ্যায়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
ডিসেম্বরের শুরুতেই বেইস ক্যাম্পে সমবেত থাকা ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সমস্ত যোদ্ধাদের নিয়ে ঢাকার চতুর্দিকে গেরিলাদের একটি বৃত্ত রচনার অপারেশন শুরু করা হয়। গেরিলাদের এক বিরাট বাহিনী ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে পৌঁছে যায় ঢাকার উপকণ্ঠে। গজারিয়া, কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, দোহার প্রভৃতি এলাকা দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে গেরিলা দলগুলো অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ও সমর সম্ভার নিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই এগিয়ে যাওয়ার পথেই ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে ঘোষণা আসে হানাদার পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের। রাত ভোর হতেই গেরিলা দল রাজধানী অভিমুখে মার্চ শুরু করে দেয় এবং সকালের মধ্যে পৌঁছে যায় ঢাকা শহরে। বিধ্বস্ত শহীদ মিনারে অস্ত্র উঁচিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম যে দলটি শপথ নেয় তা ছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ দল। হানাদার মুক্ত স্বাধীন দেশের আকাশে-বাতাসে তখন কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠের বিজয়ের জয়ধ্বনি। লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ। সেই রক্তে মিশেছে কমিউনিস্ট পার্টি-ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়নের অগণিত কমরেডের রক্ত।
এক নদী রক্তের ভিত্তির উপর এরপর শুরু-প্রগতির পথে দেশ গড়ার কর্তব্য; নব অধ্যায়। সে এক অন্য অধ্যায়, ইতিহাসের অন্য এক পর্ব। মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো প্রতিনিয়ত হাইজ্যাক হতে হতে আজ প্রায় নিঃশেষ। রক্তের দামে কেনা সেই অর্জনগুলো পুনরুদ্ধার করতে আজ প্রয়োজন নতুন আরেকটি ‘মুক্তিযুদ্ধ।’ রচনা করতে হবে মুক্তি সংগ্রামের নবতর অধ্যায়। বিজয় অর্জনের পর তা যেন আগের মতো হাতছাড়া না হয়ে যায়, সেভাবে এবার প্রস্তুত হতে হবে। তা নিশ্চিত করতে হলে, বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী শক্তির নেতৃত্বে নির্ভর না করে, কমিউনিস্ট, র্যাডিকেল প্রগতিপন্থী শক্তিকেই নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে হবে।