আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশজুড়ে হত্যা, ধ্বংস, লুটপাটের মহোৎসবের মধ্যে এই ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরের বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে।
বাংলা নিউয নেটওয়ার্ক বিশেষ প্রতিবেদন
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দখলের মহোৎসবের মধ্যে এবার রাজশাহীতে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলে যুবলীগের সাবেক এক নেতার দুটি দোকানঘর দখল করে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের অফিস করার তথ্য পাওয়া গেছে।

যুবদলের নেতাকর্মীরা কবরস্থানে গিয়ে সেই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর কবরের নামফলকও তুলে নিয়ে সেটি গর্ত করে আরেকজনকে সমাহিত করেছেন। কবরস্থানের কর্মীরা তাদেরকে অন্য জায়গায় করব দিতে বলার পর তাদেরকে হুমকিও দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগী পরিবারটির অভিযোগ, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনই নগরের শিরোইল কলোনিতে রেজাউল হক মঞ্জু নামের সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর, লুটপাট শেষে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালের এই যোদ্ধা রাজশাহী মহানগরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সভাপতি। শারীরিকভাবে অসুস্থ বলে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। ২০২২ সালে স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিছানাতেও পড়ে গিয়েছেন।
তার ছেলে তৌহিদুল হক সুমন রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি ভেঙে দেওয়া রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও ছিলেন।
সরকার পতন আন্দোলনের সময় নাশকতা ও সংঘাতের ঘটনায় সুমনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে এবং তিনি বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন।
সুমন জানান, শিরোইল কলোনি এলাকায় চার বছর আগে তার তার স্ত্রী রুমা খাতুন ও বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক মঞ্জু রেলওয়ের একটি জায়গা ইজারা নেন। ওই জায়গায় দুটি দোকানঘর ছিল।
গত ১৬ ডিসেম্বর সাবেক যুবদল নেতা নুরুজ্জামান টিটুর লোকজন ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদ করে দখলে নিয়েছেন। অথচ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত রেলওয়েকে ইজারামূল্য পরিশোধ করা আছে।
এ সময় মুক্তিযোদ্ধা রেজাউলকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এতে জীবন বাঁচাতে তিনি ঘর ছেড়েছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সুমনের দোকান ঘর দুটি তালাবদ্ধ। সামনে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল, আঞ্চলিক কার্যালয়’ লেখা সাইনবোর্ড। কথা বলার মতো সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি।
কবরেও প্রতিহিংসা
সুমন তার মায়ের কবর খুড়ে ফেলার অভিযোগও করেছেন, যার সত্যতা আবার নিশ্চিত করেছেন কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক।
মায়ের কবর নিয়ে গত রোববার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন সুমন। পোস্টে তিনি কবরের দুটি ছবিও পোস্ট করেন। একটিতে কবরের পাশে নামফলক এবং ফুলের গাছ দেখা যাচ্ছে। অন্য ছবিতে এসবের কিছুই নেই।
সুমন লিখেন, ‘আমার মা করোনায় ইন্তেকাল করেছেন। তার কবর গৌরহাঙ্গা গোরস্থানে ছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে আসাম কলোনির যুবদল নেতা পরিচয়ে আল আমিনের তাণ্ডবের শিকার আমার মায়ের কবর। সবকিছু খনন করে তুলে উপড়ে ফেলেছে। এই অনুভূতি কষ্টের জবাব কার কাছে চাইব?’
কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক আলতাফ হোসেন বলেন, সেদিন ছিল ৮ নভেম্বর, শুক্রবার। রবের মোড় এলাকার কয়েকজন সেদিন কবর খনন করতে এসেছিল। বিকালের দিকে কয়েকজন ছেলে এসে নতুন কবর খনন করতে চায়। তারা সুমনের মায়ের নামফলক তুলে ফেলে।

আলতাফ হোসেনসহ তিন জন ছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের বললাম, অন্য জায়গায় কবর দেন। তারা (সুমনের পরিবার) তো এই কবরের কাছে আসে। কিন্তু ওরা আমাদের কোন কথা শুনল না।’
উল্টো কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ককে হুমকি দিয়ে বলা হয়, ‘এখন এসব থাকবে না। আপনারা হটে যান, না হলে অসুবিধা আছে।’
‘যেহেতু পুরনো কবরের ওপর পরে আবার কবর হয়, তাই আমরা বাধা দিতে পারিনি। অন্য জায়গা দেখানো হলেও তারা এখানেই কবর করেন’-বলেন কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক আলতাফ হোসেন।
সাবেক যুবলীগ নেতা সুমনের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে তিনি মেসেজে লেখেন, ‘আমার মা বেগম তৌফায়ারা মঞ্জু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালে ২৬ জুন মারা যান। কবরটি আমরা প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করে ফুল গাছ লাগিয়ে পরিচ্ছন্ন রাখতাম। ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নুরুজ্জামান টিটু ব্যক্তিগত আক্রোশে দলের নাম ভাঙিয়ে আমার মায়ের কবর উচ্ছেদে মদদ ও আদেশ দিয়েছে বলে আমি অবগত হয়েছি।’
রাজশাহী মহানগর যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুজ্জামান টিটু পর পর দুইবার সুমনের কাছে ভোটে হেরেছিলেন। সবশেষ ২০২৩ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুজ্জামান সব অস্বীকার করে বলেন, ‘কারা সুমনের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট করেছে সেটা তিনি সিসি ক্যামেরায় দেখে নেবেন। আমি গেলে তো আমাকে দেখা যাবে।’
তাহলে কারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেটা আমি বলতে পারব না। আপনার কাছেই এটা প্রথম শুনলাম। আর দোকানঘর দখল কারা করেছে সেটা সরেজমিনে গেলেই দেখা যাবে। আমি জানি না।
“আর আমি কেন এসব করতে যাব? নিজে অসুস্থ মানুষ, ক্যানসারের রোগী। এসব আমি পছন্দ করি না। তবে যিনি আমার নাম জড়াচ্ছেন, তারও ভেবে দেখা দরকার ৫ আগস্টের আগে তিনি কেমন ছিলেন। ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ বলে তো একটা কথা আছে।”
এক সময় থাকলেও এখন যুবদলের কোনো পদে নেই জানিয়ে নুরুজ্জামান বলেন, ‘ভোট করার জন্যই দল আমাকে বহিষ্কার করে।’