জ.ই. মামুন, সিনিয়র সাংবাদিক
১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন। ৭৫ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হই আর ১৯৯২ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংক্রান্ত আমার কোনো স্মৃতি নেই। মায়ের মুখে শুনেছি, শেখ সাহেবকে কারা যেন মেরে ফেলেছে। তবে শেখ সাহেব লোকটা কে তা তখন জানতাম না।
১৯৮১ সালে ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, তখন আমি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। প্রেসিডেন্ট জিয়াকে আমি চিনতাম, টিভিতে দেখেছি। তার মৃত্যুতে আমার খারাপ লেগেছিলো। মনে আছে, তাঁর মৃত্যুর পরে দেশে বেশ কয়েক দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছিলো।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ আমি অষ্টম শ্রেণীতে থাকার সময় জেনারেল এরশাদ দেশে সামরিক আইন জারি করেন। তারপর থেকে আমি বড় হতে শুরু করি। ক্লাসের বইয়ের বাইরে ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি, যে গল্পের শেষ নেই, নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ইস্পাত, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি, এম আর আখতার মুকুলের আমি বিজয় দেখেছি, জহির রায়হানের বরফ গলা নদী, মুনীর চৌধূরীর কবর, ভ. ই. লেনিনের বিভিন্ন লাল মলাটের বই পড়া শুরু করি আর দ্রুত রাজনীতি বুঝতে শুরু করি।
স্কুল শেষ করার আগেই চিনতে পারি শেখ সাহেবকে, একাত্তরকে, জিয়াউর রহমান, কর্নেল তাহের, খালেদ মোশাররফ, জেনারেল মঞ্জুরসহ অনেক সামরিক ব্যক্তিত্বকে। অন্যেদিকে তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল, খোন্দকার মোশতাক, তোফায়েলে আহমেদ, আসম আবদুর রব, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, মনি সিংহ, কমরেড ফরহাদ, সিরাজুল আলম খানসহ অনেকের নাম আমি ততদিনে জানি। জানতে পারি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কি অমানবিক, নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে বাংলাদেশের মানুয়ের উপর, মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারগুলোর ওপর। জানতে পারি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কি নির্মমভাবে প্রায় নির্বংশ করে দেয়া হয় ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ভোরে।
কিন্তু এসবের কিছুই আমি আমার ছাত্রজীবনে পাঠ্য বইয়ে কোথাও পড়িনি। রেডিও টেলিভিশনেও কখনো বলা হতো না যে পাকিস্তানিরা আমাদের দেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। পাঠ্য বইয়ের মতো রেডিও টিভিতেও বলা হতো হানাদার বাহিনী এদেশে হত্যাযজ্ঞ চালায়, এবং মুক্তিকামী জনতা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। কিন্তু এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আমার জন্য যে একজন মহান নেতার আজীবনের আত্মত্যাগ আর সংগ্রাম আছে, একটা প্রবাসী সরকার এবং তাদের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম আছে, সেই সংগ্রামে ৩০ লক্ষ শহীদ আছে, আড়াই তিন লাখ মা বোনের সম্ভ্রম আছে তার উল্লেখ নেই। জামাতে ইসলামী, রাজাকার, আল বদরসহ পাকিস্তানী বাহিনীর দোসরদের নৃশংসতার কোনো তথ্য নেই, প্রতিবেশি ভারতে এক কোটির বেশি মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত ছিলো- তার কিচ্ছু ক্লাশ ওয়ান থেকে এম এ পর্যন্ত আমাদের পাঠ্য বইয়ে কোথাও ছিলো না।
আমাদের ছাত্রজীবন পুরোটাই ছিলো সামরিক শাসকদের বুটের তলায়। তাদের কাছ থেকে প্রকৃত ইতিহাস জানার আশাও করি না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বারের মতো পাঠ্য বইয়ে হানাদার বাহিনীর বদলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নাম উল্লেখ করা হয়।
আজ অনেক দিন পর ছাত্র জীবনের কথা মনে পড়লো। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আজ রাষ্টীয় বেতার টেলিভিশনে কোথাও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কথা নেই, আছে শুধু হানাদার বাহিনী। রাষ্ট্রপতি তো আরেক কাঠি সরেস, তিনি তার বাণীতে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে হানাদার বাহিনী স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সহযোগিতায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। কিন্তু কারা হানাদার, কারা স্বাধীনতা বিরোধী, কারা রাজাকার আল বদর- কিছুই স্পষ্ট নয়।
রিসেট বাটনের এক ধাক্কায় ছাত্র জীবনে ফিরে এলাম!