ডিজিএফআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, ৪ আগস্ট রাতে ডনাল্ড লু বাংলাদেশে দুইবার কল করেন। প্রথমে মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়াকে, পরে সালমান এফ রহমানকে। হুমকি দেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশের সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারকে ফেলে দিতে অ্যামেরিকার নানা চেষ্টা গোপন ছিল না। তবে সরকার পতনের আগে আগে এবার প্রকাশ পেয়েছে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনকেও হাতিয়ার করেছে দেশটি।
সেনাবাহিনীকে হুমকি দেওয়া হয়, কথা না শুনলে তাদেরকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না। সেই হুমকিও আর গোপনে নয়, টেলিফোন করে সরাসরিই এ কথা বলা হয়েছে।
এই হুমকি দিয়েছেন অ্যামেরিকার দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু। প্রথমে শেখ হাসিনা সরকারের মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়াকে এবং পরে বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে ফোন করে তিনি এই হুমকি দেন।
জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশন থেকে সেনা সদস্যদের যে আয় হয়, সেটি তাদের সারা জীবনের সঞ্চয়ের মত। বেশ মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাংকে বা অন্য কোনো সঞ্চয়ী স্কিমে জমা করে রাখলে সেটি বাজি জীবনের আর্থিক স্বাচ্ছন্দের নিশ্চয়তা দেয়। আর এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার খবরে বিগড়ে যায় সেনাবাহিনী।
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য যে সরকার পতন ছিল, তা এরই মধ্যে বেসরকারি টেলিভিশন নাগরিক টিভিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খোলাসা করেছেন সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। তিনি জানিয়েছেন, কোটা সংস্কার তাদের উদ্দেশ্য ছিল না, আসল উদ্দেশ্য ছিল সরকার পতন।
আর আওয়ামী লীগ সরকারকে অস্বস্তিতে রাখতে ঢাকায় অ্যামেরিকা দূতাবাসের ভূমিকা ছিল প্রকাশ্য। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে ভিসা নীতিও ঘোষণা করে অ্যামেরিকা। বিএনপি সরকারের আমলে গঠিত র্যাবের ওপর দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা, যদিও তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নতুন ছিল না।
সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের চাপে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে হয় অ্যামেরিকাকে। নির্বাচন হয়ে যায়। ফের ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর কথা বলে অ্যামেরিকা, ভারতে জি টোয়েন্টি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফিও তোলেন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
তবে তলে তলে চলতে থাকে অ্যামেরিকার ‘ষড়যন্ত্র’, সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে একটি আবেগি আন্দোলন জোরাল হয়ে উঠার পর কাজ শুরু করে তারা।
রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের একটি প্রতিবেদনে ডনাল্ড লুয়ের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে সরকার পতনের লক্ষ্যে ডাকা আন্দোলনে কোথায় কী হচ্ছে, কার কী ভূমিকা, সে বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা লেখা আছে।
এতে দেখা যায় ৪ আগস্টই শেখ হাসিনা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কথায় তিনি সেই ঘোষণা দেননি। সেই রাতে গণভবনে একটি বৈঠকে পরের দিন লং মার্চ ফর ঢাকা কর্মসূচি ঠেকানোর নির্দেশ দেন তিনি।
তবে সেই রাতেই ডনাল্ড লু কল করেন সে সময়ের মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়াকে। তিনি হুমকি দেন শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে সরে না গেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
সেনাবাহিনীকেও এই বার্তা যে আগেই দেওয়া হয়েছিল তা ৩ আগস্ট দেশের সব সেনানিবাসের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামানের বক্তব্যেই স্পষ্ট। সেদিনই তিনি বিক্ষোভকারীদের গুলি না করার নির্দেশ দেন, বলেন এমন কিছু করা যাবে না যা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করে।
অথচ সংঘাত শুরু কলে ১৯ জুলাই মধ্য রাতে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েনে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছিল। আর কারফিউ ধীরে ধীরে শিথিল করে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ছিল সরকার।
অ্যামেরিকার মোক্ষম চালটা দেওয়ার পরও শেখ হাসিনা মার্কিন চাপে নতি স্বীকার না করার সিদ্ধান্ত জানাল। রাত একটার দিকে সেনাদের কমান্ড সেক্টরে সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি সমন্বয় সভা হয়।
রাত আড়াইটার দিকে ডনাল্ড লু কল করেন সালমান এফ রহমানকে। তাকেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করার কথা বলেন আমেরিকান সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি তার মেয়াদের প্রায় পুরোটা সময়ই বাংলাদেশের দিকে শ্যেন দৃষ্টি রেখেছেন।
সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫ আগস্ট সালমান এফ রহমান গণভবনে যান। তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন। শেখ রেহানাও সেখানে ছিলেন। সজীব ওয়াজেদ জয়ও তার মাকে কল করেন। সবাই বলেন, শেখ হাসিনার নিরাপদে ভারত চলে যাওয়া জরুরি। কিন্তু তিনি রাজি ছিলেন না। পরে সবার কথায় রাজি হন।
বিবিসি যদিও লিখেছিল সালমান এফ রহমানও শেখ হাসিনার সঙ্গে উড়োজাহাজে চড়েন, সেটি পরে সত্য প্রমাণ হয়নি। তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকাতেই।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সে সময়ের একজন উপকমিশনারও বলেছেন সেনাবাহিনীর কারণেই সরকার পতন হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের লং মার্চ ঠেকানো কোনো ব্যাপার ছিল না। পুলিশের বাধা পেরিয়ে যাত্রাবাড়ী ও বা উত্তরা থেকে কেউ কিন্তু শহরে ঢুকতে পারছিল না। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও কাউকে জমায়েত হতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই উত্তরার ব্যারিকেড খুলে বিক্ষোভকারীদেরকে ভেতরে চলে আসার ইঙ্গিত দেয়। তখন আমাদের আর কিছুই করার ছিল না।’
দিনভর উত্তরা এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী একজন সংবাদ কর্মী জানান, সাড়ে ১১টার দিকে সেনাবাহিনী এই পদক্ষেপ নেওয়ার আগ পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা কেউ উত্তরাতে ঢুকতেই পারেনি। সেনা সদস্যরাই তাদেরকে উত্তরার দিকে নিয়ে আসেন। এরপর র্যাব সদস্যরাও চুপ করেছিল। মিছিলকারীরা সরাসরি উত্তরা পশ্চিম থানায় আক্রমণ করে। সেই সময়ে পুলিশেরও গুলি করার আর কোনো অবস্থা ছিল না।
এর মধ্যে টেলিভিশনগুলোতে ব্রেকিং নিউজ আসতে থাকে, সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, ততক্ষণে স্পষ্ট হয়ে যায় শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটছে। টেলিভিশনে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হেলিকপ্টারে চড়ার ভিডিও প্রচার হয়। ততক্ষণে বাধাহীনভাবে শুরু হয় লুটপাট।
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ ভবনে এই লুটপাটে কেবল জিনিসপত্র নয়, নিয়ে যাওয়া হয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদও, যা এখন মাথাব্যথার কারণ।
সেদিন থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও স্মারকগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের শিল্প কারখানায় আগুন দিয়ে লুটপাট চালানো হতে থাকে, দলের নেতাদের বাসভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও চলে লুটপাট। শত শত মানুষকে হত্যা করা হতে থাকে। কিন্তু অ্যামেরিকায় তরফে আর মানবাধিকারের কথা বলা হয় না, সুশাসন, আইনের শাসন, গণতন্ত্র আর গুরুত্ব পাচ্ছে না।