ঘটনাগুলো ঘটছে প্রকাশ্যে, কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে তা আসছে না। ভয়ে কুঁকড়ে থাকা সংবাদ মাধ্যমকে আবার ছাপতে হচ্ছে ৫৩ বছরে নাকি এমন স্বাধীনতা কখনও আসেনি।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
ঢাকার সাভারে সেবাবাহিনীর মালিকানাধীন একটি সুপারমলে তর্কাতর্কিতে যাওয়া ছাত্রদের ডাকাত আখ্যা দিয়ে কয়েক ঘণ্টা বেদম পেটানো হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের কোনো সংবাদ মাধ্যমে এই সংবাদ আসেনি।
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার মংলারগাঁও গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে বেপরোয়া হামলার মত ঘটনা বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া কঠিন হওয়ার কারণ হল স্থানীয় সাংবাদিকদের বাধা ও হুমকি ধমকি।
একটি জাতীয় দৈনিকের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি গত ৩ ডিসেম্বরের সেই হামলার পর প্রতিবেদন পাঠান ঢাকা অফিসে, তাতে তিনি ২৫ থেকে ৩০টা ঘরবাড়ি ও ১০ থেকে ১৫টা দোকান ভাঙচুরের কথা লিখে পাঠান।
ঢাকা অফিসে থেকে বলা হয়, এত দেওয়া যাবে না, তিনি যেন তিন খেকে চারটা ঘরবাড়ি আর একটি দুটি দোকানোর কথা যেন লিখে পাঠান।
সেই সংবাদকর্মী অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি মিথ্যা কথা লেখব না, চাকরি করব না।’
এই ঘটনাটি নিয়ে বিবিসি বাংলা পরে সরেজমিন প্রতিবেদন করে দেখিয়েছে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটি লণ্ডভণ্ড করে ফেলা হয়েছে।
হিন্দুদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের অভিযোগের মধ্যে এই ঘটনা কেন বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে গুরত্ব পেল না- এই প্রশ্নে সেই সংবাদকর্মীর বক্তব্যে অনেক কিছুই উঠে আসে।
তিনি বলেন, ‘আর্মি তো হামলার পর কাউকে গ্রাম ঢুকতে দেয়নি, সাংবাদিকরা গেলে তাদেরকে ফিরিয়ে দিত, কয়েকজনকে কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছে।’
তিনি জানান ১২ দিনের মাথায় একটি মামলা হলেও কোনো হামলাকারী গ্রেপ্তার হয়নি। উল্টো হামলার শিকার একটি বাড়ি থেকে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
হিন্দুদের গ্রামে হামলা আওয়ামী লীগ শাসনামলেও হয়েছে, কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে এমন ‘ব্ল্যাক আউটের’ ঘটনা ঘটেনি। বরং দিনের পর দিন ফলোআপ প্রতিবেদন হয়েছে।
তবে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার স্বাধীন যখন দাবি করছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি, তখন এই বড় বড় ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে।
যে সাংবাদিকরা সব সময় ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, তারা হঠাৎ গুটিয়ে যাওয়ার পেছনে যে ভয় ভীতি কাজ করছে তা স্পষ্ট।
গাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যার সংবাদ উধাও
গত ৬ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা দুবাইয প্রবাসী হযরত আলীকে গাছে বেঁধে পেটায়। সেদিনেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এই পরিবারটি হাসপাতাল থেকে লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
এই ঘটনায় একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে এই ঘটনাটিও আসেনি বললেই চলে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন সংবাদকর্মী বলেন, ‘কীভাবে নিউজ করব? থানা থেকে কিছু বলে না। তারা বলে সেনা ক্যাম্পে কথা বলতে। সেনা ক্যাম্প বলে আইএসপিআর (আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর) এর বক্তব্য নিতে। তারাও কথা বলে না।
উভয় পরিবারের দাবি, তাঁদের গাছের সঙ্গে বেঁধে ও ঝুলিয়ে অমানুষিকভাবে পিটিয়ে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেগতওয়া হয় এবং সেখানেই তাঁদের মৃত্যু হয়।
সাংবাদিকের সরকারি চাকুরে স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে সতর্কতা
একটি বেসরিকারি টেলিভিশনের একজন সংবাদকর্মীর স্ত্রী একটি সরকারি সংস্থাতে চাকরি করেন। সেই সাংবাদিক দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে ফেসবুকে টুকটাক লেখেন সেই সঙ্গে তার টেলিভিশনের সংবাদগুলো শেয়ার দেন।
সেই সাংবাদিকের স্ত্রীকে যেকে অফিদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একদিন বলেছেন, ‘আপনার হাসব্যান্ড কি সাংবাদিক? তিনি এত লেখালেখি করেন কেন?”
ভয় পেয়ে তিনি কথা বলেন স্বামীর সঙ্গে। বলেন, ‘এত কথা লেখার কী দরকার?
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনলাইন সেকশনে কাজ করা এক সংবাদকর্মী বলেন, ‘নিউজ তো অনেকগুলোই দেই না, যাও দেই হুটহাট করে ডিলিট করতে হয়।’
কারণ কী- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নিউজ দেওয়ার ৫/৬ মিনিটের মধ্যেই কীভাবে যেন ফোন চলে আসে। আমাদের প্রধান যিনি তিনি ভয় পান।’
আরেকজন সংবাদকর্মী বলেন, একটি প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিক থেকে ফোন আসে তাদের কাছে, জানতে চায় তারা দেবেন কি না। বলা হয়, দিলে একসঙ্গে যেন দেয়, তাহলে চাপটা কম আসে।
‘হুমকির ভাষায়’ প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের বিজ্ঞপ্তি
গত ৭ অক্টোবর একনেক সভা শেষে ব্রিফিং চলার সময় মোবাইল ফোনে আসা একটি কল কেটে সাংবাদিকদেরকে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের এত শিক্ষক… ৩০০-৪০০-৫০০ শিক্ষক সবাই কেন এত ভিসি হতে চায়, আমি বুঝি না।’
নিজের কথাও তুলে ধরে বলেন, ‘আমি তো কখনও ভিসি হতে চাইইনি।…শত শত ভিসি হতে চান, প্রো-ভিসি হতে চান, ইনারা পড়াতে চান না কেন। বুঝতে পারছি না আমি।’
শিক্ষা উপদেষ্টার এই বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এরপর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে তার প্রেস সচিবের তরফে বিবৃতিতে বুঝেশুনে সংবাদ প্রকাশ করতে বলা হয়।
বিবৃতির ভাষা ছিল এমন, ‘তার (ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ) হালকাভাবে বলা কথাকে পুরো শিক্ষক সমাজের প্রতি বিরূপ বক্তব্য হিসেবে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম সংবাদের শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেছে, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। আমরা সকল সংবাদমাধ্যমকে সতর্কতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশনের অনুরোধ জানাই।’
অর্থাৎ উপদেষ্টা বক্তব্য দেবেন এবং সেটি কোনটা ‘হালকা’, কোনটা ‘ভারী’ কথা সেটা বুঝে সাংবাদিকদের সংবাদ প্রচার করতে হবে।
নইলে কী হবে, সেই বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ হোসেনের একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই, অবশ্যই। কিন্তু আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রেখে যেতে চাই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সীমা কতটুকু?’
আওয়ামী লীগের পক্ষে যায় এমন কথা লেখা যাবে না, সেই কথাটি সরাসরি না বলে তিনি সেদিন আরও বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে বা স্বাধীনতার মাধ্যমে ফ্যাসিস্টদের প্রচার করা যাবে কি না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে ফ্যাসিস্টদের পারপাস সার্ভ (উদ্দেশ্য সাধন) করা যাবে কি না। সেই বিষয়টি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম।’
তবু সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে গত ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাহিদ বলেন, ‘তার মন্ত্রণালয় বা সরকার এই ১০০ দিনে গণমাধ্যমের কার্যক্রমে কখনোই হস্তক্ষেপ করেনি।
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছরের ইতিহাসে দেশের জনগণ ও গণমাধ্যম কখনো এমন স্বাধীনতা ভোগ করেছে কি না, তা আমাদের জানা নেই।’
সরকারের দাবির বিপরীত চিত্র রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রতিবেদনে
নাহিদ ইসলাম এমন দাবি করার এক মাস যেতে না যেতেই ১২ ডিসেম্বর বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে সাংবাদিকদের কাজের জন্য বিপজ্জনক দেশের তালিকায় নাম এসেছে বাংলাদেশের। এ বছর সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক নয়টি দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের নাম। এর পরের অবস্থান জঙ্গি হামলায় বিপর্যস্ত পাকিস্তানের, তার পরেই বাংলাদেশের।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সমর্থক পেশাদার সাংবাদিকদের হত্যা এমনকি গণহত্যার মামলার আসামি করা, ঢালাও অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল, ও ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং হত্যা মামলার আসামি করা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এতে।
আরেক বিবৃতিতে আটক সাংবাদিকদের মুক্তিও দাবি করে সংস্থাটি।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) ১০ নভেম্বর এক বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করে, ইউনূস সরকার বাংলাদেশে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করবে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর উপদেষ্টারা বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক সাংবাদিকদের আয়োজনে গিয়ে বক্তব্য রাখছেন আর কথিত নিরপেক্ষতার কথা বলছেন।
অথচ আওয়ামী লীগ সমর্থক সাংবাদিকদেরকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে, তাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে ‘ফ্যাসিবাদের সমর্থক’ নামে একটি বায়বীয় তকমা দিয়ে।
এর মধ্যে গত ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৫৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা দেওয়া হয়, যার মধ্যে ২৯ জনই পেশাদার সাংবাদিক।
ফারজানা শাকিল ও শাকিল আহমেদকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে মোজাম্মেল বাবু, শ্যামল দত্তদেরও।