মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার হিন্দুদের ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকারের মধ্যেই সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে একটি সাম্প্রদায়িক হামলার ভিডিও ও অনেক স্থিরচিত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

তবে হুমকি ধমকির মুখে স্থানীয় সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ করেও তা পাঠাতে না পারার তথ্য মিলেছে। দেশের প্রথম শ্রেণির সংবাদ মাধ্যমে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার সংবাদটি নেই বললেই চলে। দেশের প্রধান সংবাদ মাধ্যমগুলোর মধ্যে কেবল বিডিনিউজে ছোট আকারে এই হামলা ও পরের ঘটনাপ্রবাহের কিছুটা তুলে ধরা হয়েছে।

ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার মংলারগাঁও গ্রামে। ঘটনার পরম্পরা সেই পুরনো। ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ। এরপর মিছিল নিয়ে গিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট।

আওয়ামী লীগ শাসনামলেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তবে সে সময় পুলিশ খবর পেলে ঠেকানোর চেষ্টা অন্তত করেছে, হামলাকারীদের সঙ্গে সংঘাতের ঘটনায় প্রাণহানিও হয়েছে। তবে ইউনূসের জমানায় ‘তৌহিদী জনতার’ মিছিল ঠেকানোর চেষ্টা করে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এই তৌহিদী জনতা কত অবলীলায় ধ্বংসযজ্ঞ আর লুটপাট চালায়, তার সাক্ষী বাংলাদেশের শত শত মাজার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া। এর মধ্যে শেরপুর সদরে মুর্শিদপুর দোজা পীরের দরবারে তিনদিন ধরে লুটপাট চলে। দরবার শরিফের খামারের গরু, দুম্বা, টিন বা অন্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেছে মানুষ। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা।

‘তৌহিদী জনতার’ এই আক্রমণে কেবল প্রশাসন বা পুলিশ না, সেভাবে চোখ মেলে তাকায়নি বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম। সুনামগঞ্জে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটছে। অন্যদিকে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য দলগুলোকে ডেকে নিয়ে ‘জাতীয় ঐক্যের’ ডাক দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা হিন্দু নির্যাতনের খবরকে ‘কল্প কাহিনি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

ইউনূসের এই ‘কল্পকাহিনি’র দাবির মধ্যে সুনামগঞ্জে হামলায় প্রায় লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া মংলারগাঁও গ্রামের আতঙ্কিত বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অন্য জায়গায় পাড়ি জমাতে ব্যস্ত। যারা বাড়িঘরে রয়েছেন তারাও ভীত।

হামলার ঘটনাটি ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার রাতে। রাতেই ফেসবুকে ভিডিও পাওয়া যায়। কিন্তু দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো একে গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি এই হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষার্থীদের যে বিক্ষোভ হয়েছে, সেই খবর পড়তে হয়েছে ভারতীয় পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমসে।

অথচ হামলার লাইভ ভিডিও আছে। সেসব ভিডিওতে দেখা যায়, সন্ধ্যার পর আশপাশের কয়েকটি গ্রামের কিছু উত্তেজিত জনতা মিছিল নিয়ে আকাশ নামে এক তরুণের শাস্তি দাবি করেন। মিছিলকারীরা হিন্দুদের বেশ কয়েকটি বাড়িঘর, দোকানপাটে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। কয়েকঘণ্টা ধরে চলে তাদের তাণ্ডব। কিন্তু সেখানে যায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

sdSDf
সুনামগঞ্জে হামলার শিকার একটি বাড়ি। একেবারে মিছিল নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলেছে লুটপাট। ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।

বুধবার গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন সেনাবাহিনী, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা। তবে তারা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

উপজেলা পরিষদের মিলনায়তনে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনসহ সব ধর্মের ও শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের পক্ষ থেকে মতবিনিময় সভা হয়।

কিন্তু দেশের সংবাদ মাধ্যমে সার্চ দিলে হাতে গোনা এক দুটিতে কেবল এই ঘটনাটির খবর পাওয়া যায়। অথচ দেশের অন্যান্য জেলার মত সুনামগঞ্জেও সংবাদকর্মীর অভাব নেই আর সেই গ্রামেও গিয়েছিলেন প্রতিনিধিরা।

কিন্তু সেনাবাহিনী থেকে সংবাদ প্রকাশ করতে না করা হয়। কেবল তারা সংবাদ সম্মেলন করে যা বলবে, সেটা লেখা যাবে, এমন কথাও বলা হয় বলে জানাচ্ছেন সংবাদকর্মীরা।

এই ঘটনায় পুলিশ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে হামলার শিকার হয়েছে এমন পরিবারের সদস্য প্রফুল্ল দাসের ছেলে আকাশ দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, ফেসবুকে একটি পোস্টের কমেন্টে তিনি যা লিখেছেন, তাতে নাকি ইসলাম অবমাননা হয়েছে।

এখন তার বিরুদ্ধেই আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

কল্পহাহিনি বলে পার পাবেন ইউনূস?

মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হিন্দু নির্যাতনকে বেমালুম অস্বীকার করে আসছেন। শুরুর দিতে তিনি বলতেন অতিপ্রচারের কথা। এখন একেবারে ‘কল্পকাহিনি’ শব্দ ব্যবহার করছেন।

তার দাবি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ‘মুক্ত স্বাধীন নতুন বাংলাদেশকে’ মুছে দিতে ‘কল্পকাহিনি’ প্রচার করা হচ্ছে।

adsfre
সুনামগঞ্জের মংলারগাঁও গ্রামে হিন্দু গ্রাম লন্ডভন্ড হওয়ার পরের দিনই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে ডেকে মুহাম্মদ ইউনূস দাবি করেছেন, কল্পকাহিনির প্রচার হচ্ছে।

ইউনূস এই কথা স্পষ্টতই ভারতকে ইঙ্গিত করে বলেছেন। কারণ, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর ক্রমাগত হামলায় সে দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, ইউনূস ও তার সরকার স্পষ্টত ভয় পেয়েছে, তাই বিজয়ের মাসে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে ডেকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের বার্তা দিতে চাইছে।

তবে সরকার যতই অস্বীকার করুক না কেন, এসব ঘটনা সামাজিক মাধ্যমের বিকাশের দুনিয়ায় আজকাল ধামাচাপা দেওয়া কঠিন। এর প্রতিফলন দেখা গেছেন যুক্তরাজ্যের কমনওয়লেথ অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ-এপিপিজির বিবৃতিতে।

এতে দুই হাজারেরও বেশি নৃশংসতার বর্ণনা দিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামিকে সতর্ক করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, ‘আমরা এমন প্রমাণ পেয়েছি যা নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আইনকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতির অবসান ঘটানো এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব করতে ব্যর্থ হলে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর ভালো প্রভাব পড়বে না।”

রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ জানিয়েছে, ২৬৮টি মামলায় আওয়ামী লীগের ১ লাখ ৯৪ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৬ হাজার ২৬৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

সংবাদ মাধ্যম ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি স্বাধীন বলে সরকারের তরফে যে বক্তব্য এসেছে তাকেও খণ্ডন করেছে এপিপিজি।

তারা কমপক্ষে ৫৪ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আনা এবং কমপক্ষে ছয়জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের কথা তুলে ধরে লিখেছে, ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দমনপীড়নের ব্যাপক নিন্দা জানিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস-সিপিজে।”

বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরসহ বিভিন্ন মাজার ভাঙচুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যার মত সহিংসতার কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মব’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ৩৮ দিনে অন্তত ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৪ আগস্ট থেকে ২০ অগাস্টের মধ্যে ২০১০টি সাম্প্রদায়িক হামলা রয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে খুনের ৯টি, ধর্ষণের চারটি, উপাসনালয় ভাঙচুরের ৬৯টি এবং বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ৯১৫টি ঘটনা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে খুলনা বিভাগে, যেখানে চারজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন বাক প্রতিবন্ধী রয়েছেন।

এরপর গত ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন কয়েকজন এমপি।

এসব ঘটনা পশ্চিমা দুনিয়ার প্রচারের পরও ইউনূস ‘কল্পকাহিনি’ বলেছেন আর বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনা সারাহ কুককে ডেকে নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন দাবি করেছেন, এসব অভিযোগ একপেশে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here